সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১


কাদম্বরী কে...... : অনিরুদ্ধ আলি আকতার


প্রকাশিত:
২২ জুলাই ২০২০ ২৩:৩১

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:২৯

 

প্রিয় বৌঠান,

একটা সৃষ্টিছাড়া রকমের মনের ভাব কয়েকদিন ধরিয়া আমারে উতলা করিয়া তুলিয়াছে, আজ তাই লিখিতে বসিলাম। বৌঠান কড়ি-বরগা- দেওয়ালের জঠরের মধ্যে আর ভালো লাগিতেছে না। এখন আর আমাদের সেই বাড়ির ভেতরের বাগান-প্রান্তের নারিকেল শ্রেণিও নাই আর সেই তারা গোয়ালিনীর গোয়াল ঘরখানিও ছাদের ওপর হইতে দেখা যায় না। উঁকি মারিলে আর উত্তর কোণের সেই ঢেঁকি ঘরটিও চোখে পড়ে না । তবে তোমার সেই চিলেকোঠার ঘরটি আজও ক্ষুধিত পাষাণের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তোমার মনে পড়ে দক্ষিণ কোণের বারান্দার এক ধারে সেই নকল পাহাড় তৈরির কথা ? গুণদাদার ক্রীড়াশৈল হইতে পাথর চুরি করিয়াছিলাম বলিয়া সেকি হুলুস্থুল! সেদিন তুমিই তো আমাকে বাঁচাইয়া ছিলে। আজ সেই দক্ষিণের বারান্দায় বসিয়া কত কথাই না মনে ভিড় করিতেছে।
বৌঠান, বুকের হৃদপিণ্ডটা যেন হঠাৎ আছাড় খাইয়া হা-পিত্যেশ করিয়া উঠিল, কেনো জানিনা সম্মুখের খোলা ছাদে তোমার সেই সাধের পুষ্পোদ্যানের কোনো চিহ্নই আজ চোখে পড়ে না । ছাদের দিকে আগাইলেই কোন এক শূন্যতা যেন গিলিতে আসে। তবে তেতালার ছাদের বড় বড় সেই গাছগুলো আজ আমার মতোন বুড়ো হইয়াছে। নিঝুম রাতে একা যখন সেখানে দাঁড়াই তখন মনে হয়, বিচিত্র চাঁদের আলোতে গাছের ছায়াগুলো একলা প্রেতের মতো দুলিতেছে । আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে, তোমার সাধের পুষ্পোদ্যানে জ্যোৎস্না প্লাবিত সন্ধ্যায় কতই না অপূর্ব কবিতার আসর বসিত। তুমি সিক্ত সাদা রুমালে বকুল ফুল আনিতে। সামনের কেদারায় তোমার প্রিয় কবি বিহারী বাবু সারদামঙ্গল সংগীত শোনাইতেন; আর তুমি চুপ করিয়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাহার মুখপানে চাহিয়া থাকিতে। আহা!! সেকি লাবণ্য । মাঝে মাঝে তোমার বিহারী কবি কে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াও খাওয়াইতে। আর তোমার হাতে রচনা করা সেই সাধেরআসনখানি না জানি কত আদরে কবিকে উপহার দিয়াছিলে। কিন্তু আজ সব কেমন যেন ঝাপসা হইয়া আসিতেছে। চোখের জল বাগমানিতেছে না। কতদিন না ঘুমাইয়া রাত কাটাইয়াছি। চোখ বুজিলেই সেই সকল অসহ্য দৃশ্য ভাসিয়া ওঠে--
জ্যোতিদাদা দলবল লইয়া শিকার করিতে গিয়াছে। তুমি ঘরকন‍্যা সামলাইয়া কেমন যেন দিন দিন শুকাইয়া গিয়াছ। আগের মতো আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা পিঠে ঝুলাইয়া টুংটাং শব্দে ঠাকুরবাড়ি আর মাতাইয়া তোলো না। ছাদে কাপড় মেলিতে গিয়া কেমন যেন উদাস নয়নে চাহিয়া থাকো আকাশ পানে। কি জানি কি হইয়াছিল তোমার! কোন্ অব‍্যক্ত যন্ত্রণা মাতঙ্গিনী কে নির্বাক কাদম্বিনী তে পরিণত করিল!! নাঃ, না।
সেদিনটা ছিল শনিবার । জ্যোতিদাদা তখনো ঘরে ফেরে নাই । অনেক রাত অবধি তোমার চিলেকোঠায় সেজ জ্বলিতেছিল। জানালার ফাঁক দিয়া আলো আসিতেছিল ছাদে। কখন যে দমকা বাতাসে তাহা নিভিয়া ছিল জানিনে। সকালে দেখলুম বাড়ির অনেকে তোমাকে ধরাধরি করিয়া কোথায় যেন লইয়া যাইতেছে। কাছে যাইতে না যাইতেই তোমার অচেতন দেহখানি লইয়া মোটরগাড়ি দানবের মতো শব্দ করিতে করিতে ফটোক দিয়া চলিয়া গেল। কোন্ এক চাপা পড়া বেদনার তার বাজিয়া উঠিল আমার হৃদয়তন্ত্রীতে। সারারাত অন্ধকার অমারাত্রির কোন্ এক প্রেত যেন আমাকে চাপিয়া ধরিল। এক অসহ্য যন্ত্রণায় সারা রাত্র ছটফট করিতে লাগিলাম। দুইদিন এইভাবে গেল সোমবার সেই মোটরগাড়ি ফিরল, তুমিও ফিরিলে তবে........
বিশু তাঁতিনী নাকি জোগান দিয়াছিল আফিম। সকলের অজান্তে আফিমই তোমার কাছে অমৃত হইয়াছিল!!! বৌঠান!! শেষ তোমাকে দেখিলুম শুভ্র চাদর সরাইয়া। তোমার সেই চাঁদ মুখ,সেই নয়ন যুগল, সেই মুখমণ্ডল, কি হাল হইয়াছে তাহার বৌঠান!!!
আমারই কাঁধে ছিল তোমার দেহের ভার। তুমি আমার সবথেকে কাছে তখন; অথচ নিথর। বাহিরের প্রকৃতি যেন সূর্যের তাণ্ডবে দিশেহারা। তোমার সেই সাধের পুষ্পোদ্যানে সেদিন একটিও পুষ্প ফুটে নাই। গাছগুলি যেন নতশিরে নীরব দর্শক হইয়া রহিয়াছে। তুমি চলিলে শেষ যাত্রায় । হায়! ঠাকুরবাড়ির কাদম্বরী বিশাল কলঙ্কের দাগ মাথায় লইয়া চিরবিদায় লইল। বৌঠান, এ পোড়া মন আর যে ভার সইতে পারিতেছে না। শরীরটা তেমন ভালো নাই। চোখ দুটি অলস ঘুমে ঢুলিয়া আসিতেছে। লেখার শক্তি হারাইতেছি--------

তোমার প্রিয় রবি।

অনিরুদ্ধ আলি আকতার
কবি ও প্রাবন্ধিক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top