আমন্ত্রণ : অভিজিৎ চৌধুরী
প্রকাশিত:
২৩ জুলাই ২০২০ ২১:৪৭
আপডেট:
১২ মার্চ ২০২৫ ১০:৩২

১
আমরা হইলাম গিয়া কর্তা গরীব মানুষ । আমি বললাম, সে ঠিক আছে । কিন্তু এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে আমি কি ওপারে যেতে পারব !
পারবেন কর্তা । চিন্তাখান ছাইর্যা দ্যান চিন্তামণির উপর।
হেসে বললাম – কিন্তু সেই চিন্তামণিটা কে !
ক্যান , আপনার জামসেদ ।
নদীর নাম কালনাগিনী । বর্ষা চলে গিয়ে ভাদ্র মাসের আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে কিন্তু সুন্দরবন অঞ্চলের কর্দমাক্ত ভূমি কুখ্যাত । বিষধর সাপেরা এখানে জলচরও বটে । এছাড়া কালনাগিনী নদীতে রয়েছে কামট । কাদার মধ্যে থিকথিক করছে জোঁকের দল ।
বললাম, জামসেদ – মুশকিল হচ্ছে আমি তো রোগা নই ।
জামসেদ ফিক করে হেসে দিলো – সাহেব, মনিং ওয়াক করেন না আপনে !
আমি বললাম – রাস্তায় বের হলে মানুষ-জন ত্রিপল চাইবে ।
যা কইছেন কর্তা ।
এদিকে আমার কথা বলতে বলতে ছোট বাথরুমও পেয়েছে ।
বললাম – সে-কথা ।
জামসেদ বলল – আয়েন কর্তা ।
প্রায় নাক টিপে কাজটা সারলাম । চোখও বুজেছিলাম । সাপের ভয়ে শেষমেশ চোখ খুললাম । তবে ব্লিচিং দেওয়া ছিল ।
দু-বেলা ভাত খাওন ভালা নয় ।
আমি বললাম – রাতে রুটি খাই ।
এটা যাকে বলে ডাহা মিথ্যে কথা বলা ।
তাও জামসেদ বলল – ক-খান !
সাবধানে বললাম – দু-খান !
জামসেদ সন্দেহের চোখে তাকাল । বিশ্বাস করেনি বোঝা গেল ।
এবার শুরু হবে আমার বৈতরণী পারাপার বেঁচে থাকতেই ।
সরু বাঁশে ‘পা’ রেখে টলমল করতে করতে চলেছি । আর জামসেদ একবুক জল-কাদায় নেমে আমায় লগি ধরতে সাহায্য করল ।
অবশেষে স্টেজে যখন উঠলাম, সেও এক পরিত্রাহী অবস্থা । আমার ভারে মেরুন রং-এর প্লাস্টিক চেয়ার দুমড়ে-মুচরে গেল । তার আগে স্টেজে ওঠাও সে এক প্রাণান্তকর অভিজ্ঞতা । লাফ দিয়ে উঠতে হল ।
স্টেজে উঠেই আমি প্রধান অতিথি পাটাতনের ওপরে পতিত হলাম । ক্ষীণকায়, বৃদ্ধ সভাপতি করুণ চোখে চেয়ে থাকল।
জামসেদ কোনক্রমে একটা কাঠের হাতল-ভাঙ্গা চেয়ার এনে দিলো ।
গুটি কয়েক ছোকরা সিটি বাজাতে বাজাতে আওয়াজ দিল – বাপ্পি লাহিড়ী ।
বক্তব্যে বিনয় আনলাম । এমন জায়গা, এমন মানুষ – ইহজীবনে দেখি নাই ইত্যাদি ।
২
এরপর আমার আমন্ত্রণ এলো একটা থ্রি-স্টার হোটেল থেকে কলকাতায় । সুন্দরবনের জীবনের ওপরে ডকুমেন্টারি। আমাদের কয়েকজনকে ডাকা হয়েছে ।
সেখানে গিয়েও ছোট বাথরুমের ডাক এলো । বাথরুম খুঁজে আর পাইনা । অবশেষে ওয়েটার দেখিয়ে দিলো । গ্রামে চাকরি করতে করতে একেবারে গাঁইয়া হয়ে গেছি ।
কল ঘুরিয়ে জল আর বের করতে পারি না । গোঁ গোঁ আওয়াজ হয় কিন্তু জল আর বের হয় না ।
শেষমেশ বিউগেল বাজতে থাকল । হোটেলের ম্যানেজার ছুটে এলেন এবং কিঞ্চিত শ্লেষের হাসি হেসে আমায় রক্ষা করলেন ।
সুন্দরবন থেকে বদলি হয়ে ভাবলাম, কালনাগিনী থেকে মুক্তি পেলাম । কিন্তু গাঙ্গেয় সমতল ভূমিও একই । সাপ, জোঁক সবই আছ , শুধু জলে কামট নেই ।
নিশ্চিন্তে না হলেও মন্দ যাচ্ছিল না । এখানে নতুন জায়গায় একটাই ভালো – স্টেজ করে না । মাঠের মধ্যেই যাবতীয় উদ্ধোধন । চোরকাঁটা লাগে প্যান্টে ।
তবে রাত্রে ভূতেরা আসে, আর আসে শেয়াল ।
সুখেন অবশ্য আশ্বাস দেয় – ভালো ভূত এঁরা । এই যে ঘর-দোর এতো ঝকঝকে, ওরা আসে বলেই ।
কলকাতা যাওয়া হয় না । থুতুপোকা, কমলা- বউদের দেখে দিন কাটে । স্টেজে ওঠার বিড়ম্বনা এখানে নেই । তবে গা ছমছম করে রাতে , ভূতেদের ঘোরাফেরা টের পাই ।
এক রাতে এক পেত্নীর সঙ্গে আলাপ হল ।
সে আমায় বলল – আহাম্মক । তুমি কথা বলতে ভয় পাও কেন !
আমি বললাম – তা নয়, আসলে মানুষ দেখলে আমার তরাস লাগে । মনে হয় ওরা আমায় কামড়ে দেবে ।
পেত্নী আমায় ঝাড়-ফুঁক করে দিলো ।
তারপর থেকে আমার মধ্যে মিনমিনে ভাবটা চলে গেলো । গলার আওয়াজটা হল বাজখাঁই । সাহস বেড়ে গেল বিস্তর ।
দুঃসাহসে ভর করে গেলাম পাশের ব্লকের এক সভায় । লাফ দিয়ে স্টেজে উঠলাম । ভালোই চলছিল । বিপত্তি ঘটল হঠাৎ-ই।
আবার আমন্ত্রণ, শহর কলকাতায় । দুটো স্টার বেড়ে গেছে । ফাইভ স্টার । আমার ড্রাইভার নীলমণি নতুন সাফারি কিনল আর আমি পরিধান করলাম ব্লেজার ।
সবচেয়ে ভয় বাথরুম খুঁজে পাব তো ! নীলমণি তো গাড়ি নিয়ে প্রায় উড়তে উড়তে চলে এলো ফাইভ স্টারে ।
এরা আমায় বকলো-টকলো না । দু-হাত বুকের কাছে রেখে নমস্কারের ভঙ্গিতে দেখিয়ে দিলো ব্যাঙ্কোয়েট হল । যাঁরা আসছেন তাঁরা আমারই মতোন কিন্তু হাবভাব সাহেবি । আমি স্যুপ খেতে গিয়ে জামা ভেজালাম । চিকেনের রোস্ট ছিটকে পড়ল মেঝেতে । তবে ওসব কেউ দেখল না । আমার দিকে কোনরকম মনোযোগ কেউ না দেখাতে আমি যারপরনাই যাবতীয় অনাচার নিঃশব্দে চালাতে থাকলাম ।
এবার এলো সেই মাহেন্দ্র-ক্ষণ । বাথরুমে যেতে হবে । খুঁজে পেলাম, ডোরের সামনে দাঁড়াতেই খুলে গেল। এবার অন্য বিপত্তি, ঢুকেই টের পেলাম লেডিজ টয়লেট ।
ঢুকতেই দেখি সম্পুর্ণ ন্যুড একজন নারী ।
তিনি কেমন জানি অবাক হলেন না । বললেন – হ্যালো গাই, তোমার জন্য শরীরে একটা সুতোও রাখিনি । বাট ট্যু পয়েন্ট ফাইভ একটু কম হয়ে যাচ্ছে না !
কঁকিয়ে উঠলাম বললাম – আই অ্যাম সত্যব্রত মুখার্জি ।
হাউ ফানি ।
এবার গম্ভীর গলায় বললেন – হোয়াট ইজ ইউর প্রবলেম !
কোনক্রমে বুঝিয়ে বললাম ।
বললেন – শিট্ গ্যেট আউট ।
বাঁচালো একজন ওয়েটার । সে আমায় পুরুষদের বাথরুমে নিয়ে গেল ।
১০০ টাকা টিপ্স দিতে সে বলল – নো স্যার । ভদ্রমহিলার মাথা খারাপ । প্রায়ই এরকম হয় । আমরা নজর রাখি ।
বাইরে এসে গাড়িতে উঠলাম । কিছুই তেমন খাওয়া হয়নি । সবটাই তো ফ্লোর ইত্যাদিতে গড়াগড়ি খেয়েছে ।
নীলুর গাড়ি উড়তে উড়তে মিন্টো পার্কে এসে সিগন্যালে আটকে গেল ।
লাল বাতির তলায় দেখলাম একটা লোক জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে । আমার খুব চেনা । লোকটাও আমায় চিনতে পারল ।
ডাকল – কর্তা ।
আমিও বললাম – জামসেদ তুমি !
এতোক্ষণে একজন আত্মজনকে পেয়ে গাড়িতে তুলে নিলাম ।
বললাম – তুমি এখানে !
পার্টির মিছিলে আইছিলাম ।
বললাম – তারপর যা হয় আর কি !
শিয়ালদা নামিয়ে দিলে যেতে পারবে !
জামসেদ বলল – ‘হ’ কর্তা ।
যেতে যেতে পুরোনো কথা হল ।
কালনাগিনী নদী, একবুক কাদাজলে জামসেদের লগি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা । সাপ , কামট , শেয়াল , গন্ধ-গোকুল , রাতের পেঁচা – শহর কলকাতার আলোর চাকচিক্য ভুলে ওদের আমন্ত্রণ যেন আমায় ডাকছে ।
তারা আমার বড্ডো আপনজন হয়ে গেছে সেই কবে থেকে ।
অভিজিৎ চৌধুরী
পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম বঙ্গ
বিষয়: অভিজিৎ চৌধুরী
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: