সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১


দুঃস্বপ্ন আমি চাইনি : অয়েজুল হক


প্রকাশিত:
২৩ জুলাই ২০২০ ২২:১৭

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:২৫

 

আজকাল চিঠি আসার কথা নয়। চিঠির যুগ পেরিয়ে গেছে বেশ আগেই। তাহলে কী হাসান তাকে তালাকের নোটিশ পাঠিয়েছে? প্রশ্নটা বুকের ভেতর ঘুরপাক খায়।

সামান্য ঘটনাটি এতদূর গড়াতে পারে? হাসানের দোষ বলতে সে শুধু চুপ থেকেছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনি। খুটিনাটি বিষয়ে শ্বাশুড়ি আর ননদ মিলে এক প্রকার পা পাড়িয়ে ঝগড়া শুরু করতো। তারপর যা ইচ্ছা বলত। শ্রাবণী বিয়ের প্রথম দিকে চুপ থাকলেও কিছুদিন পরে জবাব দিতে শুরু করে। কতোই বা বয়স শ্রাবণীর?

সারাদিন অফিস ফেরত হাসান বাড়ি ঢোকা মাত্র একবার মায়ের চিতকার, একবার বোনের। শ্রাবণী সেও কম যায়নি। অন্যায় সহ্য করবে কেন? চিতকার করে বলেছে, হাসান তুমি চুপ করে থাকবে? হাসান মলিন মুখে শুধু বলত, উত্তর তো দিয়েই দিচ্ছ। হাসানের কথা শেষ হবার আগেই তার বোন সীমা ছুটে এসে বলত, বানরকে মাথায় উঠাতে নেই। বউকে আর আস্কারা দিস না। কথাটা সীমার কমন ডায়লগ। বলার সময় মুখের ভাবখানা দেখে মনে হতো,  যেন পৃথিবীতে তিনি একমাত্র মানুষ আর সব বানর। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে বুড়ো হতে চলেছেন কিন্তু এ দীর্ঘ জীবনে তিনি বিয়ে করার মতো যোগ্য কাউকে  পাননি। সর্বশেষ শ্রাবণী যেদিন মুখের ওপর বলে দেয়, 'সীমা আপুকে আমার সাথে সব কাজ করতে হবে।' সেদিনই বড় বিপত্তি বেধে যায়।

সীমা ছুটে এসে বলে,'এত্তো বড় সাহস! ও মা বলে কী তোমার বউ?'

ভদ্রমহিলা সবসময় মেয়ের পক্ষে। তার মেয়ে ভোটে দাঁড়ালে একটা ভোট পাবে, আর সে ভোটটি দেবেন তার মা। তিনি খড়খড়ে গলায় বলেন, 'এই মেয়ে তুমি হুকুম দেবার কে?'

-হুকুম দেব কেন? কাজের কথা বলেছি।

-আমার মেয়ে তোমার বান্দির কাজ করবে?

শ্রাবণী মুখের ওপর বলে ফেলে, 'আমি কী আপনাদের চাকর নাকি যে সংসারের সব আমাকে সামলাতে হবে?'

ভদ্রমহিলা আর সহ্য করতে পারেন না। শ্রাবণীর বাবাকে ফোন করে বলেন, আপনার মেয়েকে এসে নিয়ে যান।

মিজান সাহেব জেদি মানুষ। ঘটনা শুনে ছুটে আসেন। শ্রাবণী ছোটবেলা থেকেই বাবার আদুরে মেয়ে। এসেই চিতকার জুড়ে দেন, 'কী করেছে আমার মেয়ে?'

-কী আর করবে? আপনার মেয়ে তো রাজকন্যা। সারাদিন টেলিভিশন দেখা, খাওয়া আর ঘুমানো এই তার কাজ। কিছু বললেই খ্যাঁক করে উঠবে।

-দেখুন একদম বাজে বকবেন না।

-আমি বাজে বকছি?

-হ্যাঁ, আপনার কথাবার্তা একদম ছোটলোকের মতো।

-আপনারা বড়লোক, আপনাদের মেয়ে আরও বড়লোক। মেয়েকে নিয়ে সোজা কেটে পড়ুন।

কথা শেষ হতেই শ্রাবণী কে একপ্রকার টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান তার বাবা। হড়বড় করে বলেন, ছোট লোকের নিকুচি করি। বাড়ি ফেরার পর সেদিন রাতের বেলা হাসান অনেক বার কল দিলেও শ্রাবণী রিসিভ করেনি। কেন করবে? একেতো পিতার নিষেধাজ্ঞা তারপর হাসান একটা ভেজা বেড়াল। তার সাথে কথা বলার কোন মানে হয়না। বিষয় টা এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্ত হয়না। শ্রাবণী বুকের ভেতর একটা হাসানকে খুব করে অনুভব করে। দিন গড়াতে অনুভূতি পোক্ত হয়, সেখানে ডালপালা গজায়। মাথায় আসে ভিন্ন ভিন্ন সব ভাবনা। সত্যি তো সামান্য ঘটনা। সংসারের কাজ বলতে চারজন মানুষের রান্না। দু'জন কাজের মহিলাও আছে সে কাজে সহযোগিতার জন্যে। কোনরকম একটু দেখভাল করলেই চলে যায়। কী এমন কাজ ছিল? হাসান অনেকবার বলেছে, 'শ্রাবণী আমার তো মা। আমার জন্য তার আত্মত্যাগ আমি ভুলে যাব? মুখের ওপর তর্ক করব? তুমি একটু ম্যানেজ করে চল।'

জেদ হোক বা অহংকার, শ্রাবণী ম্যানেজ করতে পারেনি কিংবা করেনি। হাসানের মোবাইল থেকে সর্বশেষ মাস খানিক আগে একটা কল আসে। গভীর রাতে মোবাইল বেজে ওঠে। শ্রাবণী রিসিভ করতেই শোনা যায় শ্বাশুড়ির কন্ঠস্বর। কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,'আপনি?'

-হু, আমি। শয়তান টা কোথায়?

-শয়তান কোথায় আমি কী করে বলব?

মহিলার গলায় তাচ্ছিল্যের সুর, 'আমার ছেলে হাসান। বিয়ে ঠিক করেছি শুনে মোবাইল ফেলে পালিয়েছে। '

শ্রাবণী অবাক হয়ে বলে, 'হাসানের বিয়ে ঠিক করেছেন? '

-হু, তোমাকে বলেনি?

শ্রাবণী আর কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়। একের পর এক রিং বাজে। রাগে ক্ষোভে শ্রাবণী ফোন বন্ধ করে দেয়। তারপর বাবাকে বলে সিম বদল করে ফেলে।

ঘটনা শুনে শ্রাবণীর বাবা মিজান সাহেব ঘটা করে মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করেন। যেন একটা প্রতিযোগিতা। এখানে হারা চলবে না। শ্রাবণীর অমতেই বাবা হিসাবে তার কাধে চাপা মহান দায়িত্ব, মেয়েকে আরেকটা বিয়ে দেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মেয়ে তার দেখতে সুন্দরী, বয়স অল্প। নিজের ও টাকা পয়সা, সহায় সম্পত্তির অভাব নেই। কিন্তু হঠাত করে জেঁকে বসা মহামারি মিজান সাহেবের চেষ্টা প্রচেষ্টা কে আটকে দিয়েছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মাঝেমাঝে  উচ্চস্বরে শুধু বলছেন, ভাত ছেটালে কাকের অভাব হয় নাকি? কথা হয়েছে ছেলে আমেরিকা থাকে। পরিস্থিতি একটু ভালো হলেই কাজ সেরে ফেলবো।

শ্রাবণী অনেক সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকায় চিঠি বাহক বলেন, 'কিছু ভাবছেন?'

শ্রাবণী নিজেকে সামলে বলে, 'নাহ, কিছু ভাবছি না। সরি।'

কাপা হাতে চিঠি গ্রহণ করে। যে ভদ্রলোক চিঠি নিয়ে এসেছন তার আদ্যোপান্ত সাদা কাপড়ে মোড়া। যেন কাফনের কাপড় জড়ানো জীবন্ত লাশ। শ্রাবনী ঘরের দিকে পা বাড়াতেই লোকটা কথা বলে, ম্যাডাম চিঠিটা পড়ুন।

-কেন?

-ভদ্রলোক আমাকে বলেছেন আপনি যেন আমার সামনেই চিঠিটা পড়েন।

-কোন ভদ্রলোক?

-কী যেন নাম....!

-হাসান?

-হু।

শ্রাবনীর ধারণাই হয়তো ঠিক। বিয়ে করার আগে তালাকের নোটিশ পাঠিয়েছে! শ্রাবণী কে পড়তে হবে, সই করতে হবে। পড়তে শুরু করে। চারভাজ করা কাগজ খুলে পড়তে শুরু করে -শ্রাবনী,

আজ কোন এক ভাবে জেনে গেলাম ভালো আছ। আমিও চাই আজকের ভালো থাকার মত চিরটা কাল যেন ভাল থাকা হয়। কিছু ব্যাথা, অনাকাখংকিত পরিস্থিতি হয়তো জীবনে আসবে সেগুলো হাসি মুখে পাশ কাটিয়ে যেও।আমি জানি, আর তোমার ওপর আমার এ অগাধ বিশ্বাসটুকু আছে, তুমি পারবে।

চলে যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে। আমি খুব উপলব্ধি করছি আকাশের ঘন কালো মেঘ, সাগরের বড় বড় ঢেউ, আবহাওয়া বার্তার সিগনাল, একটা বড় ঝড়! কিছু মানুষ টেরই পায়না আবার কিছু মানুষের জীবন, স্বপ্ন সব ওলট পালট করে দেয়। আমি ওলট পালটের দলে হলেও চিৎকার দেবনা ভেবেছি। নিরবে, নিশব্দে ভেংগে যাব। ভেংগে যাব ধ্বসে পড়া বালির স্তুপের মতো।

দেখ, নুপুর পরা পায়ের সামান্য নড়াচড়াতেই রিনিঝিনি; আবেগীয়, মোহময়  শব্দ কতো জনের নজর কাড়ে। শব্দ আর স্বপ্নের কি এক আনন্দ যাত্রা। আবার কাটা বিদ্ধ পথিকের রক্তাক্ত পথযাত্রায় শব্দ যেমন নেই তেমনি সেখানে নেই কোন স্বপ্ন।

কাচের পাত্র নিচে পড়লে সাত পাড়ার মানুষের ঘুম ভাংগে ঠিক কিন্তু চোখের পানির শব্দ কই! কতো নিরবেই চোখ বেয়ে বুক ভিজিয়ে নিচে গড়ায়। খুব কাছের মানুষ, পাশের মানুষটি পর্যন্ত জানতে পারেনা। শোন, সব মানুষ যখন ঘরের ভেতর একটা অজানা ভয়ে; আমি তখন সাগর দেখি, নদীর পানির ছোট বড় ঢেউয়ের সাথে আমার কথা হয়। এক সময়ের প্রান চঞ্চল সড়ক গুলোয় যখন নিঃস্তব্ধতা নামে আমি পথ হাটি একা একা। আমি কার এটা বোঝার আগেই বুঝেছি, পৃথিবীতে আমি কারও নই।

- হাসান।

চিঠির ভেতর হারিয়ে গিয়েছিল শ্রাবনী। নিজের অজান্তে কখন যে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়েছে টের পায়নি। চিঠি শেষ করেই অশ্রু ভেজা চোখে প্রশ্ন করে, 'হাসান কোথায়?'

-তিনি আর নেই। ভাইরাস সংক্রমণে মারা গেছেন।

কয়েকটি শব্দ শ্রাবনী কে বাকরুদ্ধ করে দেয়। সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়;দুঃস্বপ্ন। বুকের ভেতর দাপিয়ে বেড়ায় শুধু এক চাপা আর্তনাদ - এ দুঃস্বপ্ন আমি দেখতে চাইনি। একটু সময়, তারপর শ্রাবণীর অচেতন দেহটা লুকিয়ে পড়ে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top