সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


বাঙালির কালোরাত : বোরহান উদ্দিন


প্রকাশিত:
২৩ জুলাই ২০২০ ২২:৩৬

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:০২

 

আমি চট্টগ্রাম শহরে চাকরি করি। স্ত্রী সন্তান নিয়েই থাকি। বাবা-মা গ্রামের বাড়ি থাকেন। তাই গ্রামের বাড়ি ইদানীং খুব একটা যাওয়া হয়না। আমার একমাত্র ছেলে তরিকুল ইসলাম। এবার সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। বিশেষ কারনে আমাদের গ্রামের বাড়ি যেতে হলো।
একদিন রাতের খাবার শেষে সবাই বসে টেলিভিশন দেখছিলাম। এরমাঝেই বাংলাদেশ টেলিভিশন চ্যানেলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করলো।
তখন আমার ছেলে তরিকুল, শেখ মুজিবুর রহমানকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলঃ বাবা উনি কে?
- ইনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যার জন্য আজ আমরা স্বাধীন দেশে বাস করছি।
একটু পর আবার জিজ্ঞেস করলঃ বাবা ৭ এ মার্চ কি? কি হয়েছিল মার্চ মাসে?
আমি কিছু বলতে যাবো তখন বাবা (তরিকুলের দাদা) বললেন বোরহান আমি বলছি।
এরপর বাবা মার্চের সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতা তুলে ধরেন।
দাদাভাই তখন আমার বয়স  কুড়ি বছর। তাগড়া জোয়ান ছিলাম। তখন ঢাকার এক কলেজে পড়াশুনা করি। তখন এই দেশ বাংলাদেশ ছিলনা। শুধু মুখে মুখে বাংলাদেশ ছিল। আর কাগজে কলমে ছিল পূর্ব পাকিস্তান। সেই সময় এদেশের মানুষের উপর খুব অন্যায়, অত্যাচার করতো হানাদার বাহিনী।
বর্তমান সরকার শেখ হাসিনার পিতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। তখন তিনি এই দেশের মানুষের দুঃখ, অন্যায়, অত্যাচার রোধ করতে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।
৩ এ মার্চ ১৯৭১ সাল। চায়ের দোকানে  রেডিওতে শুনতে পেলাম। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষনে গণ পরিষদের সাধারণ অধিবেশন স্থগিত করেন।
১৯৭১ সালের ৭ এ মার্চ সকাল আটটায় জানতে পারলাম। শেখ মুজিবুর রহমান রেসফোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষন দিতে আসবেন। সেদিন আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে মুজিবের ভাষন শুনতে গেলাম। কিন্তু খালি হাতে নয়। বাশেঁর চাটাই কেটে সাদা কাপড়ের উপর লিখলাম, স্বাধীনতা চাই, স্বাধীন বাংলা চাই, আমাদের অধিকার চাই। এরপর একটা লাঠির মাথায় টাঙিয়ে ফেস্টুন বানালাম। সবাই হাতে হাতে লাঠি নিয়ে পায়ে হেঁটে পথ চলতে শুরু করলাম।
সেদিন রেসফোর্স ময়দানে নেমেছিল জনতার ঢল। আমরা গিয়ে বসবার কোন জায়গা পাইনি। মাঠের কোণায় একটি গাছে উঠে অধীর আগ্রহে মুজিবের ভাষন শুনেছি।
তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্বাধীন করো, স্লোগানে লাখো জনতা মুজিবকে মঞ্চে স্বাগত জানায়। মঞ্চে উঠে যখন শেখ মুজিব বললঃ আমার ভাই ও বোনেরা। তখন আমার শরীরের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেল। সেদিন মুজিবের প্রতিটি কথা আমার শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। লাখো জনতার আত্মা পরিতৃপ্তি পায়। সেদিন এদেশকে মুজিব কখনো পূর্ব পাকিস্তান বলেনি। বলেছিল আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তাদের অধিকার চায়। বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খাঁ মার্শাল-ল জারী করে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৪ সালে ৬-দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
সেদিন মুজিব বাংলার মানুষকে বলেছেন। এই দেশের মানুষকে খতম করবার চেষ্টা চলছে-বাঙালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন। এবং আমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি আরো রক্ত দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে তুলবো ইনশাআল্লা। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
তারপর মুহূর্তেই গর্জে উঠে সারাদেশ, বাংলার ছাত্র সমাজ, ও লাখো জনতা। আর তাদের মুখে একটিই স্লোগান, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।
এরপর ২৫ শে মার্চ এলো। মেসে বন্ধুরাসহ পড়াশোনা করছিলাম। ঠিক রাত দশটার পরে বাইরে গোলাগুলির শব্দ। একপর্যায়ে হানাদার বাহিনী ঘরের দরজায় ঠকঠক করছে। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম কয়েকজন হানাদার বাহিনী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তারপর আমার বন্ধু সুভাস বোস আমার পাঞ্জাবীটা গায়ে ঢুকিয়ে নিল। পরনের ধুতিটা খুলে রাজ্জাকের লুঙ্গি পড়ে কাঁপতে কাঁপতে  আমার কাছে এসে বললঃ দোস্ত আমাকে কালিমা শিখিয়ে দে। তারপর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) শিখিয়ে দিলাম। এখন হানাদার বাহিনী ঘরের দরজায় লাথি মারতে শুরু করল। শরীরের সমস্ত শক্তি জুগিয়ে দরজার পাশে দাঁড়ালাম। এরপর আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে দিলাম। দুইজন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে আমাদের চারজনকে বাইরে বের করে উঠোনে দাঁড় করিয়ে দিল। ওদের সাথে একজন বাঙালি ছিল। এরপর ওরা দুর থেকে আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে বললঃ একে একে তোদের নাম বল।
তারপর রাজ্জাক বললঃ মোহাম্মদ রাজ্জাক, তারপর আলী বললঃ মোহাম্মদ আলী। এবার আমার পালা।আমি মোহাম্মদ বাবুল, এরপরে সুভাস কাঁপো কাঁপো গলায় বললঃ মোহাম্মদ বারেক। এবার ওরা সুভাসকে বলল কালিমা তইয়্যাবা বল? কিন্তু সুভাস বলতে পারলোনা। এরপর হানাদার বাহিনী সুভাসের উপর গুলি চালিয়ে দিল। পুরো বুক ঝাঁঝরা করে দিল ওর। সেদিন বাংলার মাটিতে রক্তাক্ত দেহে আছড়ে পড়লো সুভাস। রক্তের ছিটেফোঁটায় আমার শরীর লাল হয়ে গেল। সেদিন একটা গুলি এসে আমার হাতে লাগলো।
কিছুক্ষণ বাবা স্তব্ধ হয়ে গেল। চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়েছিল। সেই প্রথম আমি বাবার কান্না শুনেছি। আমার ছেলে তরিকুল অধীর আগ্রহে শুনছে তার দাদুর কথা। তখন তরিকুল বললঃ তারপর,  তারপর কি হলো দাদু। তুমি কি করলে। সুভাস কি বেঁচে ছিল, আর বাকি দু'জন। বাবা চোখের জল মুছে বললেন।
ডান হাত শক্ত করে ধরে মাটিতে নেতিয়ে পড়লাম। ওরা রাজ্জাক ও আলীকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। তারপর ওরা দু'জন আমার কাছে এসে বললঃ কেমন আছিস আবুল। ভালো বলে সুভাসের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললামঃ সুভাস, কিরে সুভাস। কিছুই হয়নি তোর। আমরা আছি তো এই দেখ তোর তিন ভাই এখানে। সুভাস এক হাত দিয়ে আমার শার্টের পকেট চেপে ধরে আছে। আর এক হাত দিয়ে আমার ঘাড়ে। সুভাস বললঃ ভাই আজ থেকে তোদের লড়াই শুরু। স্বাধীন বাংলা দেখে যাবার স্বাদ মিটলো না। তোরা দেশকে স্বাধীন করবি।
এরপর চোখ বন্ধ করে চিরবিদায় নিল সুভাস। সুভাসকে আর বাঁচাতে পারিনি দাদাভাই। তার মুখের নির্বাক চাহনি আজো আমার হৃদয়ে ব্যাথিত করে।
বাবা তরিকুলকে বললোঃ এবার বুঝেছ দাদাভাই।
তরিকুল হুম বলে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর ডান হাতের দুই আঙুল কপালে তুলে বলল। তোমাকে হাজারো স্যালুট শেখ মুজিব। তোমাকে হাজারো স্যালুট বঙ্গবন্ধু।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top