সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


নিমজ্জন : শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর


প্রকাশিত:
২৫ জুলাই ২০২০ ২১:৪৩

আপডেট:
২৫ জুলাই ২০২০ ২২:৫৮

শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর

 

প্রায় একযুগ পর শিহাবকে দেখে চমকে গেলাম। শিহাবের পূর্বের সে তেজ কিংবা সাহস কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই। সব গিয়ে যেন তলানিতে ঠেকেছে। সন্ধ্যায় দরজায় জোরে কড়া নাড়ার শব্দে বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে যখন শিহাবকে দেখলাম, তখন প্রথম দেখে শিহাবকে চিনতে পারিনি।
শিহাব আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। হাসি দেখে শিহাবকে চিনলাম। কারণ হাসলে ওর দুইগালে ভাঁজ পড়ে এবং মাড়ির দুপাশে দুটি দাঁত না থাকায় শিহাবকে খুব কুৎসিত দেখায়।
কোনো প্রকার সংকোচ না করে শিহাব আমাকে বলল,
বিকেলে জেল থেকে ছাড়া পেলাম। ছাড়া পেয়ে ভাবলাম তোর সাথে একবার দেখা করে যাই।

আমি কিছুটা বিব্রত হলাম। এমন দাগী খুনিকে বাসার ভেতরে নিয়ে গেলে চূড়ামণি খেপে যাবে। চূড়ামণি আমার স্ত্রী। খুঁতখুঁতে আর বদরাগী স্বভাবের কারণে চূড়ামণিকে চেনাজানা সবাই এড়িয়ে চলে। ওর জন্য আত্মীয়পরিজনের বাড়িতে
আসা যাওয়া ও যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
আমি ইতস্তুত করে বললাম,
বাসায় আজ খুব সমস্যা। অনেক মেহমান এসেছে। রাতের ট্রেনে তুই বাড়ি ফিরে যা, শিহাব।
কথাগুলো একদমে বলেই শিহাবের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলাম। শিহাব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর ম্লান হেসে টাকাগুলো ফিরিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে স্টেশন অভিমুখে হাঁটতে লাগলো।

শিহাব আমার ছেলেবেলার বন্ধু। দেওয়ানগঞ্জ কলেজে আমারা এক সঙ্গে পড়তাম। শিহাবের বাবা দেওয়ানগঞ্জের জিলবাংলা সুগার মিলের খুব অল্প বেতনের কর্মচারী ছিলেন। টানাটানির সংসারে শিহাবের বাবার একমাত্র আশাভরসার স্থল ছিলো শিহাব। কলেজে বেশ সুনাম ছিলো শিহাবের। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে কলেজে ওর জুড়ি ছিলো না। একবার কলেজের এক অনুষ্ঠানে শিহাবের কণ্ঠে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অমলকান্তি’ কবিতাটির আবৃত্তি শুনে কলেজের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি ওর প্রেমে পড়েছিলো।

আমার বয়স যখন আট বছর, তখন আমার বাবা মারা যান। আর পনেরো বছর বয়সে মারা যান মা। দেওয়ানগঞ্জে বড় ভাইয়ের আশ্রয়ে থাকতাম। ভাবি আমাকে সব সময় উটকো ঝামেলা মনে করলেও প্রকৃত মায়ের আদরটুকু আমি শিহাবের মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। শিহাবের মা প্রায়ই বলতেন,
নিরঞ্জন, তুই আমার আরেকটা ছেলে। কোনো কিছুর দরকার হলে সোজা এই মায়ের কাছে চলে আসবি। একটুও লজ্জা পাবিনা, বাবা।
সত্যিই কলেজ জীবনে শিহাবের মা আমাকে পরম আদরে আগলে রেখেছিলেন। তিনি শিহাব আর আমাকে কখনো আলাদা করে দেখেননি।

ইন্টারমিডিয়েটে ভালো ফলাফল করে শিহাব আর আমি দুজনেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। উল্লেখ্য, সেবার শিহাব দেওয়ানগঞ্জ থানার মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করেছিলো। আমার ফলাফলও ছিলো গর্ব করার মতন।
দিন গড়াতে থাকলো। ইউনিভার্সিটিতে শিহাবের বন্ধুর সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। একসময় শিহাবের কাছে আমি গুরুত্বহীন হয়ে পড়লাম। অভিমানে শিহাবের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলাম।
শিহাব সেটা বুঝতে পারলেও আমার মান ভাঙানোর কোনো চেষ্টাই সে করেনি। বরং আমার কাছ থেকে শিহাব ধীরে ধীরে নিজেকে আড়াল করে নিলো।

শিহাবের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি অনেক দিন হয়। ওর ডিপার্টমেন্টের একজনের কাছে জানতে পারলাম, পড়াশোনায় শিহাবের আর আগের মতন সিরিয়াসনেস নেই। নিয়মিত ক্লাস করাও নাকি ছেড়ে দিয়েছে। শুনে খুব খারাপ লাগলো। শিহাবের মা বাবার কথা মনে পড়লো। আহা ! কতনা উদ্গ্রীব হয়ে আছেন তাঁরা ছেলের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ আশায়।
একদিন অভিমান ঠেলে শিহাবের সাথে দেখা করতে ওর হলে গেলাম। শিহাবের রুমমেট বলল,
শিহাব এখন খুব একটা থাকেনা এখানে। কি যেন একটা বিজনেস করে। মাঝে মধ্যে আসে।
কোথায় থাকে জানতে চাইলে সেও কিছু বলতে পারলো না। হতাশ হয়ে রুমে ফিরে এলাম।

ব্যস্ততার কারণে অনেক দিন শিহাবের খোঁজ নেয়া হয়নি। মাস্টার্স শেষ করে গে-ারিয়ায় একটা কলেজে যোগদান করলাম। একদিন বাহাদুরশাহ্ পার্কের কাছ দিয়ে বাংলাবাজার যাওয়ার পথে হঠাৎ শিহাবের সাথে দেখা। উষ্কোখুষ্কো চুলে উদভ্রান্তের মতন লাগছিলো শিহাবকে। শিহাবকে এ অবস্থায় দেখে অবাক হলাম। পার্কে বসে অনেক কথ হলো ওর সাথে। পরীক্ষায় ড্রপ দেয়ার কারণে এখনো পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। শিহাবকে বাসার ঠিকানা দিয়ে মজা করে বললাম,
স্থায়ী ঠিকানা বলতে পারিস। শ্বশুরের একমাত্র কন্যারত্নকে বিয়ে করেছি। রাজ্য আর রাজকন্যা দুটোই এখন আমার। শিহাব খুব অবাক হলো। বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল,
শেষ পর্যন্ত তুই ঘরজামাই হলি। তোর সম্মানে বাধলো না, শিহাব ?
আমি আর কথা বাড়ালাম না। শিহাবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গন্তব্যে চলে গেলাম।

একদিন দুপুরে শিহাব আসলো আমার কলেজে। কলেজের শিক্ষক ক্যান্টিনে বসে ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে আড্ডা দিলাম। নানা আলাপচারিতার পর শিহাব নির্লিপ্তভাবে আমাকে বললো,
তোর কাছে কিছু টাকা হবে, নিরঞ্জন ?
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম। দরিদ্র হলেও শিহাবের আত্মমর্যাদাবোধ প্রকট ছিলো। শত অভাবেও শিহাব কারো কাছে হাত পাততো না। সেই শিহাবের এমন কি হলো যে সে আমার কাছে টাকা চাইছে ? দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
কত টাকা ?
শিহাব কোনোরূপ ভণিতা না করেই সোজাসুজি উত্তর দিলো,
এই ধর, পঞ্চাশ হাজার টাকা ! পার্টির জরুরী কাজে প্রয়োজন। এক সপ্তাহের মধ্যেই ফেরত পাবি, ভাবিস না।
আমি শিহাবের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। তারপর বললাম,
কোন পার্টিতে যোগদিয়েছিস, শিহাব ? তুইতো কখনো রাজনীতি পছন্দ করতিস না।
শিহাব হকচকিয়ে গেলো। আমার প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিলোনা। খানিকটা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
এসব পার্টিফার্টি তুই বুঝবিনা, শিহাব। তুই মাস্টার মানুষ মাস্টারি নিয়েই থাক।

শিহাবের কথা শুনে কেনো যেনো ভয় পেয়ে গেলাম। কি জানি, কোনো জঙ্গি সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়লো নাতো ?
আজকাল চারিদিকে নানা জঙ্গি সংগঠনের জোর তৎপরতার কথা শোনা যাচ্ছে। গলাঝেড়ে বললাম,
এতো টাকা আমি কোথায় পাবো, শিহাব ?
শিহাব বিরক্ত হলো। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
ঠিকই তো, এতো টাকা তুই কোথায় পাবি ? তোর কাছে ধার চাওয়াটাই আমার উচিত হয়নি !
এই বলে শিহাব কলেজ থেকে বের হয়ে একটি রিক্সা নিয়ে সদরঘাট অভিমুখে প্রস্থান করলো। এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। শিহাবের সাথে আর কোনো দিন দেখা হয়নি আমার।

ভিটেমাটির প্রতি টান না থাকায় দেওয়ানগঞ্জ যাওয়া হয় না দীর্ঘ দিন। সেবার স্ত্রী ছেলে মেয়ের পুনঃপুন অনুরোধে গ্রীষ্মের ছুটিতে দেওয়ানগঞ্জ গেলাম। এক বিকেলে সুগার মিলে বেড়াতে গিয়ে শিহাবের মায়ের কথা মনে পড়লো খুউব। শিহাবদের বাড়িতে গেলাম ওর মা বাবার খোঁজ নিতে। আমাকে দেখে শিহাবের বাবা কেঁদে ফেললেন। কাঁদাকাটার পালা শেষ হলে কাঁদার কারণ স্বরূপ তিনি আমার কাছে শিহাবের জীবনে ঘটে যাওয়া অবর্ণনীয় কষ্টগাথার বিবরণ দিলেন,
ইউনিভার্সিটি জীবনের শেষ দিকে শিহাব কোনো এক জঙ্গী সংগঠনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়ে। খুনের দায়ে শিহাবের যাবজ্জীবন সাজা হয়। শিহাবের মা শিহাবের এই অধঃপতন সহ্য করতে না পেরে অনুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন ।

শিহাবের মতন মেধাবী তরুণের নিদারুণ করুণ পরিণতি ও শিহাবের মা বাবার বিড়ম্বিত অবস্থার কথা চিন্তা করে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। শিহাবের মা বাবার কাছ থেকে দুঃখভারাক্রান্ত মনে বিদায় নিলাম চলে এলাম।

ঢাকায় ফিরে শিহাবকে দেখতে সেন্ট্রাল জেলে গেলাম, কিন্তু সেদিন সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত দিন না হওয়ায় দেখা না করেই ফিরে আসতে হলো। নানা ঝামেলায় আর কখনো শিহাবকে দেখতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। শিহাবের কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম।

আজ দীর্ঘ দিন পর শিহাব আমাকে দেখতে এসেছিলো। শিহাব আমাকে দেখতে এসেছিল কৈশোরের রুপোলি দিনগুলোর নিখাদ ভালোবাসার দাবি নিয়ে। সযতেœ লালিত ¯েœহ মমতার অধিকার নিয়ে। শিহাবের মনে সমুদ্র সমান বেদনা আর হতাশার যে পাহাড় জমে আছে, হয়তো তা আমার সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে কিছুটা হালকা হতে চেয়েছিলো। ভীষণ কষ্ট পেলাম শিহাবকে ফিরিয়ে দিয়ে। এভাবে শিহাবকে বিদায় দিতে আমার মন না চাইলেও শিহাবের পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত জীবন ওকে লক্ষ যোজন দূরে সরিয়ে দিয়েছে আমাদের বন্ধুত্বের সীমারেখা থেকে। যতদূর দেখা যায় শিহাবের বাড়ি ফেরার পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর ঘরে ঢোকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্ফুটে বললাম
আমাকে ক্ষমা করে দিস, শিহাব। যেখানেই থাকিস ; ভালো থাকিস।

 

শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top