সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১


নাটক: চর (পর্ব ১) : ইমন শেখ


প্রকাশিত:
২৬ জুলাই ২০২০ ২১:১৫

আপডেট:
২৬ জুলাই ২০২০ ২১:৫৪

 

[চরিত্রসমূহ: মগবুল চেয়ারম্যান, আলতাফ মাস্টার, কদম, হারান, মজনু, মুরালি, আক্কাস, কবির, বসির, কাসেম, ইমাম, পুরোহিত, পরান, কেষ্ট]    

দৃশ্য -

[গভীর রাত। ঝিঝি পোকা ডাকছে। চেয়ারম্যানের বৈঠকখানায় একটি হারিকেন মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। গম্ভীর মুখে সিগারেট ফুকছে মকবুল চেয়ারম্যান। ইট ভাটার চিমনির মতই তার লম্বা নাকের ছিদ্র থেকে সিগারেটের কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়া ঊর্ধ্বে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে যে বেশ রেগে আছে সেটা তার সফেদ দাড়ি বেষ্টিত কালো মুখ দেখলেই বোঝা যায়। ঘরের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে উত্তর প্রান্ত,উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্ত বিরতীহীন চলন গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছিল কদম। মগবুলের পায়চারির সাথে তাল মিলিয়ে একবার ডানে একবার বামে মাথার বিরতিহীন সঞ্চালন তার মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটায়। মাথাটা স্থির করে বৃদ্ধ আর শাহাদাৎ আঙ্গুলের সমন্বয়ে ঘাড়ের সিরায় চাপ দিয়ে বেশ আরাম পায় সে। ইতিমধ্যে খেয়াল করে পাশে বসা হারান ঘুমে ঢুলছে।]

 

কদম  : (দাঁত কিড়মিড় করে এবং নিচুস্বরে) এই হারান দা। হারান দা।

ঝিঁঝির ডাক আর মগবুলের পায়চারির মচমচ আওয়াজের উপরিপাতনে কদমের স্বর হারানের কানে পৌছায় না। কদম হাত বাড়িয়ে ঝাঁকুনি দিতেই চমকে ওঠে হারান।

হারান: (চিৎকার করতে গিয়েও সামলে নিয়ে) সারাদিন বহুত খাটনি গেছে শরীলটার উপর। তাই ইটটু ঘুম মানে ইয়ে... হেহে।

কদম: বহুত খাটনি গেছে (মৃদুস্বরে ব্যাঙ্গ করে)।

হারান : কী ব্যাপার? চেয়ারম্যান সাব ক্ষেইপা আছে মনে হইতাছে। (রতনের কানে ফিসফিস করে)

কদম : কিছুত বুঝবার পারতাছি না। হেই যে কিয়ের লাইগা খাপ্পা মাইরা আছে?

[কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ থাকে। চেয়ারম্যানের পায়চারির গতিবিধির সাথে তাল মিলিয়ে দুটো মাথা একবার ডানে একবার বামে ঘুরতে থাকে। যেন চাবি দেওয়া কলের পুতুল। হঠাৎ চেয়ারম্যান চেয়ারে বসে পড়ে। হারান ও কদম দৌড়ে আসে চেয়ারের কাছে।]

কদম : হুজুররে আইজ বড্ড চিন্তত্ লাগতাছে?

হারান : ঈশশ! ঘাইমা নাইয়া গেছে শরীলডা। হুজুর, ইটটু বাতাস করি। (পাখা খুজতে উদ্যত)

চেয়ারম্যান : (হাত উচু করে) থাক থাক। বাতাস করতি হবে না। বাতাস করলে নাহয় শরীলের উপরডা জুড়োবে, ভেতরডা? আহ! ভেতরডা আমার জ্বইল্যা পুইড়া যাইতাছে।

কদম : তাইলে হুজুর কেরামত ডাক্তাররে খবর পাডাই?

চেয়ারম্যান : ডাক্তার! -ওসব ডাক্তার  কইবরেজে কিচ্ছু করবার পারব না। ডাক্তার হুহ। (তাচ্ছিল্য করে)

হারান : গোস্তাকি মাফ কইরেন। আমি কলাম কিচ্ছুই বুঝবার পারতাছি না। একটু খুইল্যা বলেন যদি (শেষের দিকে কণ্ঠস্বর মিইয়ে যেতে থাকে।)

চেয়ারম্যান : হেইডা বুঝবার গেলে মাথায় ঘিলু থাওন লাগে, ঘিলু।

কদম : হারান দার মাথায় যে গবর ভরা হেইডা কিন্তু বহুত আগেই বুঝবার পারছিলাম।

চেয়ারম্যান : তুমিত বুঝবাই। তোমার মাথাডাও তো একই জিনিসে ঠাসা। তুমি বুঝবানা তো কেডাই বুঝব?

[প্রথম দিকে কদমের মুখে হাসি থাকলেও চেয়ারম্যানের কথার শেষের দিকে সে গম্ভীর হয়ে যায়। হারান অবশ্য বেশ মজা পায়। গোঁফের তলায় লুকানো হাসিতেই সেটা বোঝা যায়।]

হারান : তয় ঘিলু থাউক আর গবরই থাউক আইজ অবদি কোন কাজে ফেল মারিনি হুজুর।

কদম : হেইডা কিন্তু হাছা কথা হুজুর (নরম সুরে)

চেয়ারম্যান : কোন কাজে ফেল মারিনি (ব্যাঙ্গ করে)। ফেল মারলে কি আর বিগের পর বিগে জমি জেরাত হয়? পাকা দালান হয়? (হারানের দিকে তাকিয়ে) বছর বছর ঘরে বউ আসে? (কদমের দিকে তাকিয়ে)

কদম : না। মানে মাত্তর ৩ জনরে ঘরে আনছি। অহনও একখান বাকি আছে।

চেয়ারম্যান : বাহ! একজন নাগছে দালান গাঁথতি। আরাকজন আউশ মেটায় ৪ বিবির। বাহ! বাহ! ওদিকে আমার যে কাছা খুলবার জো সেই  দিকি খিয়াল আছে? সামনে যে ইলেকশন আইতাছে হেইডা কি মাথায় আছে?

হারান : আলবত আছে হুজুর। ও নিয়ে চিন্তার কী আছে?

কদম : হ হুজুর। আপনের ফিল্ড ফাস্টোকিলাস। আপনেরে ঠেহাই কেডা?

চেয়ারম্যান : ফাস্টোকিলাস? চিন্তার কিচ্ছু নাই? (রেগে আগুন) আমার নামে গিরামে কীসব রটিছে তার খবর রাহো তুমরা? আমি নাকি পাহা চোর। রিলিফের চাইল চুরি করি, ঢেউটিন চুরি করি। ফহিন্নির বাচ্চারাত বোঝেনা আমি চিয়ারে আছি বুইল্যা ১০ কেজির জাগায় ৫ কেজিত পাচ্ছিস। সবটা যদি লোপাট কইরা ফালাই কোন হালারপুত কী কইবার পারে? তলের ভাত নুন দিয়ে খাওয়া লাগে না তো। ফহিন্নির বাচ্চারা।

হারান : হুজুর, ঐ আলতাফ মাস্টারই সব নষ্টের গুড়া। গিরামের হগ্গোলের মাথা চাবায় খাচ্ছে কিসব অধিকার ফধিকারের কথা কয়ে।

কদম : হ হুজুর। ব্যাটার মুহি হগ্গোল সুমায় খালি শোষণ-বঞ্চনা-অধিকার ইসব কথা। মরণ! হে ব্যাটা হগ্গোলেরে ফুসলায়।

চেয়ারম্যান : জানি। সব জানি। আলতাফ  মাস্টের, স্কুলের মাস্টার হইয়া তুমার সাধ মেটে নায়। গিরামের মাস্টার হইবার চাউ? হুহ, আমার লগে লাগবার চাউ? একবার খালি বাকে পাই। মাস্টের তোরে বুঝাই ছাড়ুৃম এইডা তোর ঐ টিনের ছাউনির কিলাস রুম না যে তুই ছড়ি ঘুরাবি। এইডা হইল আমার গিরাম। এর মাস্টার আমি। আমি একা (উত্তেজিত কণ্ঠে)।

হারান : হুজুরের চিন্তা কী? ঐ ব্যাটারে এক্কেবারে তক্তার নাহান সুজা কইরা ফালাইবো না? খালি কন দেহি একবার।

কদম : এইগুলান আমাগো উপর ছাইরা দিন, হুজুর। এক্কেবারে কিলিয়ার কইরা দিমু। এই অধম গুলামগুলো অহনও বাইচা আছেতো  নাকি?

চেয়ারম্যান : হ। তুমাগে উপরে ছাইড়া দিয়া বইসা থাহি। এক্কেবারে উদ্ধার কইরা দিবো।

কদম : হুজুর, ব্যাটারে জন্মের তরে সরাইয়া দেই? ল্যাঠা চুকে যাক। আপনে শুধু দেখবার লাগেন কি করি।

চেয়ারম্যান : না (গর্জে উঠে), ও কাম করা যাবি না। আখেরে আমারই ক্ষেতি হইবো। সামনে ইলেকশন। বুইঝা সুইঝা রয়ে সয়ে কাম করতি হবি।

হারান : হুযুর ক্ষেতি হবি ক্যা? পথ কিলিয়ার হবি। এক্কেবারে কিলিয়ার। ফকফকা কিলিয়ার।

চেয়ারম্যান : বাতাস অহন উল্টো ডাঙ্গায়। মাথা গরম করিছো তো সব শ্যাষ।

কদম : তাইলে হুজুর করবেনডা কী?

চেয়ারম্যান : কী করবো? হাহাহা। এমন কাজ করবো যাতে ঘরও পোড়বে, আলুও পোড়বে।

হারান : ঠিক কতা হুজুর। ঘরের লগে মাস্টেরও পুইড়া রোস্ট হবি। আর আলু পোড়া খাওনের লাইগা আমরাতো আছি।

কদম : আমি কিন্তু হুজুরের কতা কিছু বুঝবার পারলুম না। গোস্তাকি মাফ কইরেন। এইসব ঘর পুড়া, আলু পুড়া(কথা শেষ করতে পারে না)

চেয়ারম্যান : বুঝবা কদম, বুঝবা।সময় হইলে সব বুঝবা। সময়ের আগে কিচ্ছু বুঝা যায় না। হাহাহা। উল্টো ডাঙ্গা থিকা বাতাস আবার সদর ডাঙায় ফিরবো। তহন কলজের এই জ্বলন আর থাকবি না।

[চেয়ারম্যান উঠে দাঁড়ায়। বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়েও দরজা থেকে আবার ফিরে আসে।হারান ও কদম উভয়কে লক্ষ্য করে চেয়ারম্যান কথা বলবে।]

চেয়ারম্যান : শুনলাম কালিগঙ্গায় নাকি চর জাগিছে?

কদম ও হারান (একসাথে) : ঠিকই শুনিছেন হুজুর।

চেয়ারম্যান :আচ্ছা, বহুৎ খুব। তোমরা কাইল আবার আইসো। এইবার ফাইনাল খেলা খেলতি হবে।

[দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে চেয়ারম্যান বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরে কদম ও হারান একসাথে বেরিয়ে যায়।]

 

২য় দৃশ্য

[বাজার বসেছে। মজনুর চায়ের দোকানে বেশ ভিড়। সেখানে আলতাফ মাস্টার, মুরালি, আক্কাসসহ আরো দুয়েকজন থাকবে।]

আলতাফ : (এক হাতে চায়ের কাপ) ও মুরালি, ব্যাপার কী? তোমার মেয়েটা  দুইদিন হইল ইস্কুলে আসে না। অসুখ বিসুখ কিছু হলো নাকি?

মুরালি : আজ্ঞে না মাস্টার সাব। ওরতো বিয়ে দিয়ে দিলাম।

আলতাফ : বিয়ে দিলে? মানে? অতটুকুন মেয়ের বিয়ে দিলে?

মুরালি : আজ্ঞে ভাল একটা সম্মন্ধ পেলাম। ছেলের বাড়ির অবস্থা ভালো। বড় বাজারে মাছের আড়ৎ আছে। জমিজমাও আছে বেশ। মাইয়াডা সুখি থাকবি তাই আরকি।

আলতাফ : কাজটা ভালো করলে না মুরালি। মেয়েটা খুব মেধাবী ছিল। পড়ালেখা চালিয়ে গেলে অনেক ওপরে উঠতে পারতো।

মুরালি : মাস্টার সাব, আপনি তো জানেন আমার অবস্থা। কতদূর আর পড়াতি পারতাম। বিয়াতো দেওন লাগতোই। ইটটু না অয় আগেই হইলো।

আলতাফ : (চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে) যা - ই বলো  অমন একটা বাচ্চা মেয়ের বিয়ে দিয়ে তার ভবিষ্যতটা নষ্ট করে দিলা। কাজটা ঠিক করোনি মুরালি। ঠিক করোনি।

মুরালি : গরীবের মাইয়ার আবার ভবিষ্যৎ। যাহোক মাস্টার সাব অহন উঠি। ক্ষেতে যাতি হবি।

[কিছুটা তাড়াহুড়ো করে মুরালি চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে যাবে। যেতে যেতে নিচু স্বরে মাস্টারের শেষ কথাগুলি ব্যাঙ্গ করবে। মাস্টার বিষন্ন মনে একদৃষ্টিতে মুরালির যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকবে। সেসময়ে দোকানে আক্কাস প্রবেশ করে।]

আক্কাস : ও মজনু ভাই, কড়া কইরা এক কাপ রং চা বানাও দেহি। একটা সিগারেট (উচ্চারণ করতেই মাস্টারের দিকে চোখ পড়বে। একটু থতমত খেয়ে জিব কাটবে সে) থাক।  খালি চা দেও অহন।

মজনু : (হাসি মুখে) বস দাদাভাই। অহনই দিতাছি।

আক্কাস : সালেমালেকুম মাস্টার সাব। আছেন কেমন? শরীলডা ভালা তো?

(মাস্টারের ঘোর ভাঙবে। আক্কাসের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করবে।)

মাস্টার : ও আক্কাস। আছি বাবা। আল্লার ইচ্ছায় ভালোই আছি। তোমার খবর টবর কী?

আক্কাস : এই চলে যাচ্ছে আরকি। তা মাস্টার সাব ভাবছিলাম ছোট ভাইডারে ইস্কুলে ভর্তি করাবো। নিজি তো পড়ালেখা শিখলাম না। দেহি ভাইডারে যদি মানুষ করা যায়।

মাস্টার : (খুশিতে মুখখানা উজ্জ্বল হবে) এতো খুব ভালো কথা। আক্কাস, তোমার মতো সবাই যদি বুঝতো।  আর একটা কথা - আমি ভেবেছি তোমাদের মত যুবকদের নিয়ে আলাদা একটা স্কুল খুলবো। তোমরা যুবক। দেশের ভবিষ্যৎ। তোমরা লেখাপড়া না শিখলে কী হবে?

আক্কাস : কিন্তু মাস্টার সাব ইস্কুলি যাবডা কহন? এটটু পরেই ক্ষেতে যাতি হবি। সারাদিন কত কাম। ইস্কুলি গেলি সংসার চলবো কেমনে ? বাপজান সেই যে বিছানায় পড়লো অহনো  সুস্থ হইলো না। আপনেতো সব জানেন।

মাস্টার : জানি বাবা, জানি। আমি ভাবছি তোমাগো নিয়া নৈশ ইস্কুল খুলবো। দিনে কাজকর্ম করবা। আর রাতে স্কুলে ঘন্টা দুই টাইম দিলেই হবে। লেখাপড়া শিখে তোমাদের মানুষের মত মানুষ হতে হবে। নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে হবে। নিজেদের ভালমন্দ নিজেদেরই বুঝতে হবে। কেউ তোমাদের  ঠকাতি পারবে না।

আক্কাস : মাস্টার সাব সেই ছোট্টবেলা থেইক্কা দেইখা আসতাছি আপনে সবসুময় গেরামের ভালা চান। আপনি যহন কচ্ছেন নিশ্চিত ভালাই হইবো। আমি আইজই মন্টু, চেংটু, বৈরাগী, জয়দেব, কৃষ্ণ ওগো লগে এই ব্যাপারে কথা কবো।

মাস্টার : তাই করো বাবা। আমাগো তিনকালের আড়াই কালতো চলেই গেল। অহন তোমরাই আশা ভরসা।

[মজনু চা দিয়ে গেলে আলোচনার ইতি ঘটবে। মাস্টার উঠে দাড়াবে। দোকান থেকে বেরোনোর সময় মসজিদের ইমাম আর মন্দিরের পুরোহিত ঢুকবে। মাস্টারের সাথে তারা কুশল বিনিময় করবে।]

পুরোহিত : কিহে মাস্টার, উঠলে নাকি?

ইমাম : আরে মিঞা, বসো বসো। আরেক কাপ চা খাও নাহয়।

মাস্টার : অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। কিন্তু এখন আর চা চলবে না। স্কুলের সময় প্রায় হয়ে এলো। এদিকে আবার কিছু বাজার সদাইও করতে হবে। মাফ করবেন। এখন উঠতেই হবে।

[ইমাম, পুরোহিত আর নিজের চায়ের দাম মজনুকে দিয়ে মাস্টার দোকান থেকে বেরিয়ে যাবে। তার মুখে একটা স্বর্গীয় আনন্দের আভা ফুটে উঠবে। আর স্বগোতক্তিতে বলবে - গ্রামের চায়ের দোকান সত্যি দারুণ জায়গা। চাষা-ভূষা, জেলে, কামার, কুমোর, হিন্দু -মুসলমান, ইমাম পুরোহিত, সাদা-কালো কোনো ভেদাভেদ নেই। চায়ের পেয়ালা তো না, সবার হাতে যেন অমৃতের পেয়ালা। গোটা দেশটাই যদি চায়ের দোকান হতো! সবজায়গা যদি এরকম ভেদাভেদহীন হতো তাহলে সবার হাতেই অমৃতের পেয়ালা শোভা পেত।]

  ৩য় দৃশ্য

[চেয়ারম্যানের বৈঠকখানা। হারান ও কদম নিচে আর চেয়ারম্যান চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবে। মুখে থাকবে পান। সামনে ছোট টেবিলের ওপর পিকদানি থাকবে। একটা হারিকেনও জ্বালানো থাকবে।]

চেয়ারম্যান : কি হে, তোমাগো খবর কী?

হারান : আমাগো আর খবর! তয় আমাগো খবরের চায়েও দরকারি একখান খবর আছে। শুনলাম মাস্টের নাহি রাইতে ইস্কুল খুলবো।

কদম : হ হুজুর। গেরামের চ্যাংড়াগুলানরে নাচাচ্ছে ঐ ব্যাটা নচ্ছার। হুহ! কয় তোমাগো লেহাপড়া শিকা লাগবি। নিজেগো অধিকার বুইজে নেওন লাগবি। কেউ তোমাগো ঠগাতি পারবো না।

হারান : হুজুর, আরো কয় নিজেগের ভালোমন্দ নিজেগো বুঝা লাগবি। কন দেহি গেরামের মাথা হইলেন গিয়ে আপনে। সবার ভাল-মন্দ  দেখবেনতো আপনে। তা না। ব্যাটা আছে হগ্গোলরে চেয়ারম্যান বানানোর ধান্ধায়।

কদম : হুজুর ঐসব রাইতে ইস্কুল টিস্কুল হইলো ভড়ং। ব্যাটায় আসলে পোলাপানগুলানরে আপনের বিরুদ্ধে ফুইসলাইবো। আমরা কি আর এসব চালাকি বুজি না? ভাত পানি তো চাড্ডে খাই নাকি?

[পান চিবোতে চিবোতে চেয়ারম্যান সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তারপর পানের পিক শব্দ করে পিকদানিতে ফেলবে। এসময় ঠোঁটের কোন বেয়ে একটু লাল রস বের হবে। রুমাল দিয়ে তা মুছে নেবে।]

চেয়ারম্যান : হাহাহা। হাহাহা। হাহাহা। (উচ্চ শব্দে)

[কদম আর হারান দুজনেই একটু অবাক হবে। উভয়ের মুখেই বিস্ময় ফুটে উঠবে এবং আড়চোখে একজন আরেকজনের দিকে তাকাবে।]

হারান : হুজুর আপনে হাসতাছেন? (বিনয়ের সাথে এবং তোতলানো ভঙ্গিতে বলবে।)

কদম : আমার কিন্তু ট্যানশন হচ্ছে। মাস্টার ব্যাটার লাগাম অহনি টাইনা ধরতি হইবো। নইলে হে যা করবার লাগছে তাতে আমাগো বারোডা বাজবো।

চেয়ারম্যান : হাহাহা। হাহাহা। হাহাহা। (উচ্চ শব্দে)

হারান : হুজুর আপনের হাসি দেইখা আমারও হাউশ জাগিছে এটটু হাসার। এটটু হাসি হুজুর?

চেয়ারম্যান : হাসবা? তো হাসো।জিগাও কেন? হাসো হাসো। হাহাহা। হাহাহা।

(চেয়ারম্যান হাসবে হাহাহা করে। আর হারান হেহেহেহে করে থেমে থেমে।)

কদম : আমি কিন্তু কিছুই বুজবার পারতাছি না। আপনে হাসেন লগে হারানদাও হাসে। (কণ্ঠে বিরক্তি ও হালকা ঝাঁজ থাকবে।)

[চেয়ারম্যান হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যাবে। হারান তখনও হেসে যাবে। কিছুক্ষণ পর এদিক ওদিক তাকিয়ে চেয়ারম্যানকে গম্ভীর দেখে সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে হাসি থামিয়ে দেবে।]

চেয়ারম্যান : কদম, এই যে দেখলা আমি হাসলাম, তার পেছনে দুইডা কারণ আছে। তুমরা এই যে খবর সংগ্রহ করতিছ, তুমাগো টেনশন হচ্ছে, অনেক কিছু আচ করবার পারতেছো এইডা হইলো গিয়ে দুই নম্বর কারণ।

কদম : এক নম্বরডা কী?

চেয়ারম্যান : এক নম্বরডা হচ্ছে ক্ষমতা পোক্ত করার উপায় আমি পায়ে গেছি। আর কাজে কর্মে তুমাগো এই উন্নতি দেইখা আমি বুঝবার পারতাছি তুমরা আমার পিলান বাস্তবায়ন করতে পারবা।

হারান : হুজুর, পিলানডা কি? (বেশ উত্তেজিত হয়ে বলবে)

চেয়ারম্যান : কালীগঙ্গায় চর জাগিছে। চর যহন জাগিছে তহন সেইহানে ঠাঁইও পাওয়া যাবি। তুমরা যদি ঠিকমতন কাজ করবার পারো তাইলে  এই চরের ওপর চেয়ারখান এমনভাবে গাড়ুম যে এর থেইক্কা কেউ আমারে নামাবার পারবো না।

হারান : (চেয়ারম্যানের কথায় খুব আশান্বিত হয়ে আনন্দের আতিশয্যে একটু জোরে বলে উঠবে) বুজবার পারছি। চর নিয়া হুজুর নতুন কোনো ফন্দি আটছেন।

কদম : ( হারানকে ধমক দিবে) আহ! হারান দা, আস্তে বলো, আস্তে। দিয়ালেরও কান আছে।

চেয়ারম্যান : ভুল বললা কদম। ভুল বললা। দিয়ালের কান নাই। তয় দিয়ালের মুখ আছে। দিয়াল কথা কয়।

কদম : হুজুর বুজবার পারলাম না।

হারান : আমিও কিচ্ছু বুজবার পারলাম না। তয় কথাডা শুনতে ভারী মিঠে লাগলো। দিয়ালের মুখ  আছে। দিয়ালও কথা কয়।(রিপিট করবে)

চেয়ারম্যান : মসজিদ মানে আল্লাহর ঘর দেহোনি? মন্দির দেখছোনি? কাউরে কি কয়ে দিয়া লাগে কুনডা মসজিদ আর কুনডা মন্দির? কেউ না কইলেও বুজা যায়। দিয়াল যদি কতা কইবার না পারতো তাইলে কি এইডা বুজা যাইত?

হারান : আমরা হলাম গিয়ে মুখ্যু সুখ্যু মানুষ। অত্তকিছু মাথায় ঢোকে না। তয় কথাডা শুইনা মনে হইলো বিরাট জ্ঞানের কথা।

চেয়ারম্যান : জ্ঞানের কতা না হারান। এইডা কামের কতা। আর ঐ যে কইলা মুখ্য সুখ্য বইলা বুঝবার পারো না - এই কতাডাও ঠিক না। যে যত মুখ্য সুখ্য হইবো হেই হগ্গোলের আগে বুজবো। হ্যার মাথায় হান্দানো এক্কেবারে সঅজ।

কদম : হুজুর আর এটটু যদি খুলাসা করেন তাইলে ভালা হয়।

চেয়ারম্যান : শোন, হিসাব নিকাশ বহুত করছি। তারপর এই বুদ্ধি বাইর হইছে ঘট থিকা। ও মিয়া কউ দেহি এই গেরামে মোসলমান বেশি না কি হিন্দু বেশি?

কদম : মোসলমান বেশি। হিন্দুতো হাতে গুনা কয় ঘর।

হারান : হ, হিন্দু আর কয়জন - দক্ষিণ পাড়ায় কয়ঘর জাইলে আর ওদিক পিরামানিকরা কয়ঘর। আর এদিক সেদিক দুই এক ঘর আছে আরকি।

চেয়ারম্যান : ভাইবা দেহোতো হগ্গোল মোসলমান যদি আমারে ভোট দেয় তাইলে কী অবস্থাডা হবে? জিত কেউ আটকাতি পারবি? হিন্দুগো ভোট না অয় এবার নিলাম না। কি কউ?

হারান : হুজুর, আমাগো ভোট নিবেন না! এসব কি কন?

চেয়ারম্যান : না না। রাগ কইরো না হারান। এরে কয় পলিটিক্স। জিততি আমার হবোই। এই পথডাই একমাত্র ভরসা অহন। তাছাড়া তুমি হিন্দু হইলেও আমার খাস লোক। তোমারেতো আমি ওগে লগে এক পাল্লায় মাপতি পারি না। আর এই পিলানের আদ্ধেক কাজ তুমারই করোন লাগবো।

হারান : (জিভ কেটে) কি যে কন হজুর। রাগ করুম কেন? আপনার কোনো পিলানতো আইজ অব্দি ফেল মারতে দেহি নাই। আপনি জিতলি আমার কি ক্ষেতি? আমারইতো লাভ। তাইলে রাগ করুম ক্যান? ছিছিছি! আপনার নুন খাইয়া আপনের লগে গোস্বা? না না।

চেয়ারম্যান : এই তো বুজদারের মতন কতা। বাহ! বাহ! বড়ই খুশি হলাম।

কদম : কিন্তু হুজুর, হগ্গোল মুসলমান আপনেরে ভোট দেবে এইডার কোনো গেরান্টি আছে? কুকথা যেভাবে রটিছে তাতে (বাকীটা বলতে ইতস্তত করবে)।

চেয়ারম্যান : দেবে, কদম। দেবে। গেরান্টি নাই ঠিক কতা, তয় গেরান্টি হইতে কতক্ষণ? তোমরা কামডা ঠিকমতন করবার পারলি ভোট ওগো দিতি হবিই।

কদম : হুজুর, কাজডা তাহলি কী?

চেয়ারম্যান : না! কাজ খুব কডিন না। একখান চর জাগাতি হবি।

হারান : চরতো কালিগঙ্গায় জাগছে। বিরাট চর হুজুর।

চেয়ারম্যান : হাহাহা। সেইডা কী আর কইতে হয়? ঐ চরের ওপরই আরেকখান চর জাগাতি হবি। আরো বড় চর। যারে কয় ধর্মের চর। এবার হবি চর চর খেলা। বুজলা চরের খেলা। হাহাহা। হাহাহা। শোনো তাইলে-

[তিন মাথা একজায়গা হয়ে শলা পরামর্শ করবে। মাঝে মাঝে কদম ও হারানের মুখ থেকে হা হু আওয়াজ শোনা যাবে।]

(চলবে)


বিষয়: ইমন শেখ


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top