সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


শাপ : অরুণ কুমার বিশ্বাস


প্রকাশিত:
২৬ জুলাই ২০২০ ২১:৪৩

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:৫৯

 

একটি বেসরকারি সংস্থার মুখ্য গবেষক আফসার সাহেব। বয়স চল্লিশের কিছু বেশি, চেহারায় সম্ভ্রান্তির ছাপ সুস্পষ্ট। চাইলে খুব সহজেই তিনি কোন সরকারি দপ্তরের জাঁদরেল অফিসার হতে পারতেন। সেই মেধা ও প্রয়োজনীয় সংযোগ, যাকে আমরা বলি হাই কানেকশান, তা তার ছিল। কিন্তু সেসব কিছু চান নি আফসার উদ্দিন। কিছুটা অন্তর্মুখি প্রকৃতির লোকটি কথা কম বলেন, অকারণ বগল বাজানো পছন্দ করেন না। বরং এ জাতীয় মানুষ তিনি সযতেœ এড়িয়ে চলেন। অর্থাৎ স্বভাবতই তিনি আড্ডাবাজ নন। বন্ধুবৎসল হবার তো প্রশ্নই ওঠে না।
আফসার মনে করেন বেঁচে থাকাটা নেহাতই নিয়তি, বিলাসিতা নয়। কিছু করে খেতে হয়, তাই তিনি গবেষণার কাজে নিয়োজিত আছেন। এক্ষেত্রে মাসমাইনে বা বোনাস তাকে মোটেও প্রলুব্ধ করে না। কাজ করলে বেতন নিতে হয় তাই নেন। বস্তুত আফসার সাহেবের আর্থিক কোন টানাপোড়েন নেই। তিনি স্বচ্ছল ও বনেদি পরিবারের সন্তান। যথেষ্ট অর্থসম্পদ রেখেই তবে তার বাবা হাফিজ উদ্দিন ইন্তেকাল করেছেন।
যদি বলি আফসার উদ্দিন অসামাজিক- খুব একটা ভুল বলা হবে না। অবশ্য এই সংসারে সবাইকে যে চাহিদামাফিক সামাজিক ও পরার্থপর হতে হবে এমন কোন কথা নেই। মানুষ বরং প্রকৃতিগতভাবেই স্বার্থপর। অন্যের সাথে সে ঠিক ততটা ঘনিষ্ঠ হয়, যতটা হলে আখেরে তার সুবিধে হয়।
আফসার সাহেব এতদিন একাই ছিলেন- এবং তাতে তার এমন কিছু সমস্যাও ছিল না। তবে কাছে দূরের টুকটাক তার যা কিছু আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন তাদের চাপেই শেষমেশ তাকে একজনের পাণিগ্রহণ করতে হয়। সম্প্রতি শায়লা নামে এক বিচক্ষণ মেয়েকে বিয়ে করেছেন আফসার উদ্দিন। আর সেখানেই সমস্যার শুরু- কারণ তার ধারণা, শায়লা এসে তার কৌমার্য হরণ করেছে। একাকীত্ব ঘোচানোর নাম করে তার ব্যক্তিজীবনে অহেতুক শুলুক-সন্ধান শুরু করেছে। সময়টা এখন বড্ড দুর্বহ মনে হয় গবেষক আফসারের কাছে।
অবশ্য শুলুক-সন্ধান মানে এই নয় যে ত্রিশোর্ধ্ব শায়লা খুব বেশি প্রশ্ন করে আফসারকে। বরং এক্ষেত্রে উল্টোটা হয়েছে। এত কম কথা বলে বলেই হয়তো শায়লাকে আফসার রীতিমতো সমীহ করে চলে। কথা কম বললেও চোখের চাহনি দিয়ে ওটুকু পুষিয়ে নেয়। চোখ তো নয়, যেন অনুবীক্ষণ যন্ত্র।
গৌরচন্দ্রিকা অনেক হল- এবার মোদ্দা কথায় আসি। আফসারের বিবাহিত জীবন সুখের হয় নি। কৌমার্য বিসর্জন দিয়েছে বটে, বিনিময়ে পেয়েছে সে সামান্যই। সত্যি বলতে, বাসর রাতে ওসব অঘটন কিছু ঘটেই নি। বেডরুমের ভেজানো দরজার দিকে পিঠ ফিরে দাঁড়িয়ে শায়লা সন্দিগ্ধ চোখে আফসারকে কিছুক্ষণ দেখেছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলে নি। আফসার দিনভর অকারণ টেনশনে ক্লান্ত ছিল। তাছাড়া নারীলোলুপ হিসেবে তার তেমন কুখ্যাতিও নেই। সব মিলিয়ে মোটামুটি পানসে কেটেছে আফসার-শায়লার বিয়ের প্রথম রাত। একটুও বি¯্রস্ত হয় নি শায়লার কামগন্ধা কাঁচুলি, এলোমেলো হয় নি গভীর কেশরাশি। বরং যথেষ্ট নিটোল ও নিভাঁজ ছিল তাদের বাসরশয্যা।
বউয়ের সাথে তার বোঝাপড়া হয় নি। একছাদের নীচে দুজন ভিনগ্রহের মানুষ ঘোরাফেরা করে। কেউ কারো মনের খবর রাখে না- দেহেরও না। এক সময় হাঁপিয়ে ওঠে আফসার। কেমন এক বিজাতীয় ভয় দখল নেয় আফসারের বুকে।
শায়লা বেকার নয়। সে নারী স্বাধীনতায় বিশ^াস করে। স্বামীর অর্থবিত্তের জৌলুশে কোন রুচিশীল মেয়ে নিজেকে হারাতে পারে না। শায়লা একটা ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে পড়ায়। তার ধারণা, স্বনির্ভরতা বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।
শায়লা বাকপটু নয়, তবে রান্নার হাত ভাল। নুন-মশলার সূক্ষ্ম হিসেব-নিকাশ ভাল বোঝে। তবে যার জন্য আয়োজন, সেই আফসার খাবারটেবিলে বড়ই ব্যস্ত থাকেন। এমনও হতে পারে, শায়লাকে তিনি একদম বরদাস্ত করতে পারেন না। অথবা তার নিজেরই কোন খামতি আছে, যার কারণে স্ত্রীর মুখোমুখি হতে তিনি ভয় পান।
কী সেই খামতি ? কিসের এত ভয় আফসারের ?
সেদিন হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় আফসার উদ্দিনের। অভ্যেসবশে টিপয়ের উপর রাখা টেবল ল্যাম্পের সুইচ অন করেন। রাতে ঘুম ভাঙলে বড্ড তেষ্টা পায় আফসারের। জগে পানি রাখা থাকে। তিনি ঢকঢক করে পানি খান। গলাটা ভিজিয়ে নেন।
সেদিনও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। মাথার কাছে আলো জ¦াললেন। পোরসিলিনের জগ থেকে পানি ঢেলে খেলেন আফসার। কিন্তু শায়লা কোথায়! বিছানায় নেই। গেল কোথায়! ওয়াশরুমে ? হতেই পারে।
টেবল ল্যাম্প নিবিয়ে দেন আফসার। ঘুমানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে সহজে নিদ্রাদেবী সদয় হন না। অবশ্য বয়স চল্লিশ পেরোলে শারীরিক কিছু অনিয়ম দেখা দেয়। অপর্যাপ্ত ঘুম তার অন্যতম। চোখ বুজে থাকেন আফসার। অপেক্ষা করেন শায়লার ফিরে আসার।
আরো একটি কারণে তার এই জেগে থাকা। কী অশ্চর্য! অনেক দিন বাদে তার শরীর কেমন যেন সাড়া দিচ্ছে। নিজের ভেতরে এক রকম কামস্পৃহা অনুভব করেন আফসার উদ্দিন। নিজেকে প্রস্তুত করেন তিনি। কিন্তু শায়লা এখনও আসছে না কেন!
এক সময় অধৈর্য হয়ে পড়েন গবেষক আফসার। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়ান। নাহ, শায়লা ভেতরে নেই। আলো জ¦লছে না। অতি লাজুক প্রকৃতির মেয়ে শায়লা। তবে কি সে ওয়াশরুমও অন্ধকার করে রাখে, নিজেকে যাতে দেখতে না হয়! অ্যাবসার্ড!
একি! ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে একাকী কাঁদছে শায়লা! কিন্তু কেন, কিসের এত দুঃখ ওর! তিনি এগিয়ে যাবেন! কী করা উচিত ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না আফসার উদ্দিন। কাছে গিয়ে বুকে টেনে নেবেন- তারপর সযতেœ চোখ মুছিয়ে দেবেন শায়লার ! নাহ্ বড্ড নাটুকে আর প্যানপেনে মনে হয়। আদতে এমন ধারা রোম্যান্টিক ও সুসংবেদী মানুষ তো তিনি নন।
অগত্যা চোরের মতো চুপিচুপি বিছনায় এসে মটকা মেরে পড়ে থাকেন আফসার। বৈরী পারিপাশির্^কতার কারণে কামভাব তিরোহিত হয়। এবং এক সময় তিনি ঘুমিয়েও পড়েন।
পরদিন অফিসে গিয়ে মোটেও সুস্থির হতে পারেন নি আফসার। কাজে মন বসছে না। একটা জরুরি আপডেট দেবার আছে। অথচ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রাতের ঘটনা। বলা হয়নি, আফসার যে অফিসে কাজ করেন, ওটা মূলত একটি ফরেন-ফান্ডেড রিসার্স সেন্টার- মনস্তাত্বিক ক্রাইসিস নিয়ে কাজ করে। তবে আফসার নিজে মনোবিজ্ঞানের এক্সপার্ট নন। তিনি অন্যদিক দেখেন।
এই প্রথম আফসার ভাবলেন, মানুষ আসলে দ্বীপ নয়। আর তিনিও রবিনসন ক্রুসো নন। শায়লার ব্যাপারটা তাকে বড্ড ভাবাচ্ছে। কারো সাথে শেয়ার করা দরকার। যাকে অন্তত বিশ^াস করা যায়।
ইয়েস, ফায়েজ আলম। আফসারের কলিগ। ফায়েজ মানুষ ভাল। মনোবিজ্ঞানের ছাত্র। সদয় ও বন্ধুবৎসল হিসেবে তিনি সুবিদিত। তারা দুজন একই লেভেলের অফিসার তাই কারো ঘরে যেতে কাউকে পারমিশান নিতে হয় না। হঠাৎ আফসার সাহেবকে নিজের রুমে আবিষ্কার করে যারপরনাই চমকে যান ফায়েজ। আবিষ্কার বললাম এই জন্য যে, গত পাঁচবছরে এই চিড়িয়াটিকে কেউ কারো রুমে যেতে দেখে নি। নেহাত প্রয়োজন পড়লে অন্যরা যান আফসারের রুমে।
ফায়েজ নিবিষ্ট মনে কাজ করছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অযথা বাগাড়ম্বর চলে না। অর্থপূর্ণ গলা খাঁকারি শুনে চোখ তুলে দেখেন- আফসার উদ্দিন।
আরে, আফসার ভাই যে! সূর্য আজ কোন্ গগনে উঠলো ? বসুন বসুন, বসতে আজ্ঞা হোক। স্বভাবসুলভ অন্তরঙ্গ সুরে হৈহৈ করে উঠলেন ফায়েজ আলম।
আফসার তারল্যে যোগ না দিয়ে মাপা স্বরে বললেন, একটু দরকার ছিল।
অমনি সজাগ হন ফায়েজ আলম। সে আর বলতে, চরম কোন বিপর্যয় না ঘটলে তার ঘরে এই লোকটির আগমন! সোজা ইউটার্ন নিয়ে স্বরে হাজার কিলোওয়াট গাম্ভীর্য ঢেলে ফায়েজ শুধোলেন, খুব আরজেন্ট ? মানে হাতের কাজটা সেরে ... !
ইয়েস, ইট ইজ। আফসার বললেন। কিন্তু তার আগে একটা প্রশ্ন-।
ওকে, করুন। কফি দিকে বলি ? ফায়েজ সোজাসুজি আফসারের চোখে চোখ রাখেন।
নো, থ্যাঙ্কস। ব্যাপারটা সত্যি গুরুতর।
প্রশ্নটা করুন আফসার ভাই। আপনি আমাকে বন্ধু ভাবতে পারেন। অফিসে আপনাকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। আমি বলি না। কারণ দুনিয়ার সবাই আমার মতো হবে এটা ভাবার যৌক্তিক কোন কারণ নেই।
গুড এবং আবারও ধন্যবাদ ফায়েজ ভাই। আমি কি আপনাকে বিশ^াস করতে পারি ?
নিঃসন্দেহে। তবে খুব বেশি পারসোনাল হলে আরেকটু ভেবে দেখুন শেয়ার করবেন কি না! ফায়েজের সুরে বাড়তি সিরিয়াসনেস।
বারদুই ঢোক গিললেন আফসার উদ্দিন। একটু সময় নিয়ে তারপর বললেন, ব্যাপারটা আমার স্ত্রীকে নিয়ে।
এবার বিচলিত বোধ করেন ফায়েজ। স্বামী-স্ত্রীর বিষয়ে তিনি ইন্টেরেস্টেড নন। ঘরোয়া ব্যাপার ঘরে বসে সামলানো উত্তম। বাইরে এলে সংকট কমে না, বরং জটিলতা তৈরি হয়। কিন্তু আফসার নাছোড়বান্দা। ফায়েজকে তিনি বলবেনই। পুরো অফিসে এই একজনকে তিনি ট্রাস্ট করতে পারছেন।
বলুন তাহলে, আমি কথা দিচ্ছি আর কেউ জানবে না। সম্ভব হলে আমি যেটুকু পারি হেল্প করবো।
পুনঃ গলাখাঁকারি এবং দুম করে কথাটা যেন ছিটকে বেরুল আফসারের মুখ থেকে। আমার স্ত্রী শায়লা রাত জেগে কাঁদে।
সে কি, কেন ?
জানি না।
প্রতিরাতেই ?
জানি না। তবে দুএক রাত দেখেছি।
ফায়েজ আর আগে বাড়লেন না। পরে কথা হবে বলে উঠে পড়লেন। তার এক আত্মীয় হাসপাতালে ভর্তি। দেখতে যাবেন। গবেষণা করেন বলে তো সমাজধর্ম সব শিকায় তুললে হবে না। লোকে মন্দ বলবে যে!
পরদিন লাঞ্চের পরে ফায়েজ নিজে থেকে আফসারের রুমে গেলেন। ভ্যানতারায় না গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করেন, আপনি কি ভাবিকে টরচার করেন ? ফায়েজের অনুমান, এ জাতীয় গোমড়ামুখো ইনট্রোভার্ট লোকেরা রন্ধনশিল্পের মতো রমণশিল্পের ছলাকলারও ধার ধারেন না। সাদরে চুমু খেতে গিয়ে হয়তো আবেগের আতিশয্য হেতু সপাটে কামড় দিয়ে বসেন।
সহকর্মীর কথা শুনে বোধ হয় আহত হন আফসার। মিনেমিনে গলায় বলেন, আসলে ওটি করি না বলেই হয়তো সে কাঁদে।
অদ্ভুত যুক্তি! মনে মনে হাসলেন ফায়েজ আলম। আদরে বাঁদর তৈরি হয় শুনেছি। তাই বলে অনাদরে ক্রন্দন! বাপের জন্মে শুনিনি। তাহলে এক কাজ করুন আফসার ভাই- আজ রাতে ওকাজটি করুন। ভাবির বুকের খুব কাছে মুখ ডুবিয়ে জানতে চান, রাত জেগে সে কেন কাঁদে। উত্তর পেয়ে গেলে ভাল, নইলে বুঝবেন ভেতরে প্যাঁচ আছে। সমস্যার আরো গভীরে যেতে হবে।
বলতে নেই, সহকর্মীর উপদেশ বিলক্ষণ পালন করেছেন আফসার উদ্দিন। তাতে কাজের কিছু হয় নি, বরং হিতে বিপরীত। বিশেষ মুহূর্তে শায়লা গোখরোর মতো ফোঁস করেছে, ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। গবেষক স্বামীকে যেন বোঝাতে চেয়েছে, তোমার কাজ ফরমায়েশি কলম পেষা। ভালবাসার মতো মামুলি ব্যাপার তোমাকে মানায় না।
ছি! অপমান। সামান্য একটি স্কুলটিচার তাকে এভাবে হটিয়ে দিল! আফসারের কী নেই, শায়লা যা একজন পুরুষের কাছে প্রত্যাশা করতে পারে। মাথার ভেতরটা তার ঝিমঝিম করতে থাকে। রাগে অপমানে তাড়িত হয় আফসার। ঢকঢক করে পুরো একজগ পানি খেয়ে নেয়। নারীর চাহিদার কাছে কি সে এতই আনাড়ি!
পরদিন অফিসে আফসারকে অচেনা লাগে ফায়েজের। লাল চোখ, অবিন্যাস্ত চুল। দেখে বেশ বোঝ যায় ফায়েজের কথামতো কাজ করতে গিয়ে সে কুপোকাত। লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে সে-কথা বলেও দিয়েছে।
তাহলে এবার উপায় ? শায়লা কাল রাতেও কেঁদেছে। বোবাকান্না নয়, রীতিমতো ফুঁপিয়ে।
বেচারা আফসার! একটু অমিশুক বটে, তবে লোক সে মন্দ নয়। তার কষ্টটা ফায়েজকে আলোড়িত করে। মানুষের মনোজগৎ নিয়ে তার কাজ-কারবার।
ফায়েজ বললেন, আমি তোমার স্ত্রীকে একবার মিট করতে পারি, যদি কিছু মনে না করো।
কোথায় ?
ভাল হয় তোমার বাসায় মিট করতে পারলে। তুমিও থাকবে। তবে সে যেন বুঝতে না পারে। বুঝতেই পারছো, তোমার উপস্থিতি তাকে স্বাভাবিক হতে দেবে না। আই নিড টু মিট হার অ্যালোন।
ঘাড় নেড়ে সায় দেন আফসার। এবং সেদিনই সন্ধ্যায় ফায়েজ পৌঁছে যান বিপন্ন সহকর্মীর বাড়িতে। বাড়িটা ওদেরই। আফসারের বাবা হাফিজ উদ্দিন বিয়ের যৌতুক হিসেবে পেয়েছিলেন। কথা ছিল ফায়েজ আগে যাবে, তারপর পরিস্থিতি বুঝে আফসার ঢুকবে তার বাড়িতে। আফসারের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে। ঢুকতে অসুবিধা হবার কথা নয়। ফায়েজ শুধু কথার ফাঁকফোকরে ব্যস্ত রাখবেন শায়লাকে।
কলবেল টিপলে শায়লা এসে দরজা খোলে। সবিস্তারে নিজের পরিচয় দেন ফায়েজ। আফসারের বন্ধু, একই অফিসে কাজ করেন। কেন গিয়েছেন তার কৈফিয়ত হিসেবে মামুলি গোছের কিছু একটা বলেন ফায়েজ। কিন্তু শায়লা তাতে মোটেও সন্তুষ্ট নয়। বরং সন্দিগ্ধ সুরে জানতে চায়,
এনি আইডি প্রুফ? মানে যা দেখে আপনাকে আফসারের ফ্রেন্ড হিসেবে লোকেট করতে পারি!
ও ইয়েস। দিস ইজ মাই অফিশল আই-কার্ড। ইন ফ্যাক্ট, আমরা মুখোমুখি ডেস্কে বসে কাজ করি।
শায়লা সম্ভবত ফায়েজের বাচালতায় বিরক্ত হয়। মনে মনে বলে, এত কিছু কে জানতে চেয়েছে ইউ ব্লাডি ফুল! বেটার ইউ টক টু দ্য পয়েন্ট। মনের ভাব গোপন করে অফুরান নির্লিপ্তি নিয়ে আইডিকার্ড নেড়েচেড়ে দেখে শায়লা। তারপর বলে, প্লিজ ভেতরে আসুন। ও কিন্তু নেই। আই মিন আফসার, আমার স্বামী।
আমি জানি। তবে এসে পড়বে এক্ষুণি। বেকুবের মতো বলে বসলেন ফায়েজ।
আপনি জানেন! কিভাবে ? নাকি সে-ই আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে!
পরিস্থিতি সামাল দিতে বোকার মতো একটু হাসেন ফায়েজ আলম। তারপর নিজে একজন মনোবিজ্ঞানী এই বিষয়টি জানান দিয়ে বলেন, একটি বিষয়ে আলাপ করতে চাই। খুব বেশি সময় নেব না। এই ধরুন মিনিট কুড়ি!
ওকে, ক্যারি অন। আই’ম প্রিটি শিওর আপনি আফসারের গুপ্তচর হিসেবে এখানে এসেছেন। নো প্রবলেম, আপনি প্রশ্ন করুন। আমি জবাব দিচ্ছি। সত্যি বলতে, আমিও একটা মাধ্যম খুঁজছিলাম। কিছু কথা বলার ছিল।
গুড। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারলে শুরুতেই বলি, আফসারের সাথে আপনার ঠিক যাচ্ছে না, তাই না ?
এটা আপনার প্রশ্ন, নাকি ¯্রফে কমেন্টস ? সহাস্যে বলে শায়লা। এই প্রথম ফায়েজের মনে হল আফসারের বউ যথেষ্ট সুশ্রী, শিক্ষিতা এবং বুদ্ধিমতী। হাসিটা অপূর্ব। কী বলা যায় একে- শুচিস্মিতা।
ফায়েজ যথেষ্ট স্মার্টলি বললেন, ধরুন দুটোই। আমার বন্ধু কিন্তু মানুষ ভাল।
সার্টিফিকেট দিচ্ছেন! তা দিন। আমি কিন্তু বলিনি আফসার খারাপ। অপছন্দ হলে কি তাকে বিয়ে করতাম!
তাহলে ? সমস্যটা আসলে কোথায় একটু বলবেন! আমার মনে হয় আমি আপনার কোন কাজে আসতে পারি। নৈর্ব্যক্তিক টোনে ফায়েজ বললেন। যদিও তিনি এই মুহূর্তে বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠেন। শায়লার সাহচর্য তাকে রীতিমতো প্রাণিত করে।
একটু সময় নেয় শায়লা। ওর পেছন দিকে ঘরের প্রধান দরজা। একফাঁকে ইয়েল লকে চাবি ঘুরিয়ে টুক করে ভেতরে ঢুকে পড়েন আফসার। ভারি পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন। ফায়েজ টের পান, শায়লা নয়। কারণ সে তখন ভাবনার এক অন্যজগতে পাল তুলে দিয়েছে।
কফি এলো। কফিতে সন্তর্পণে ঠোঁট ছোঁয়ান ফায়েজ। তাড়া দেন শায়লাকে- কী হল, বলুন।
তাড়া খেয়ে দুম করে বলে বসে শায়লা- ইউ মে নট বিলিভ, আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখি। রোজ।
দুঃস্বপ্ন, আই মিন নাইটমেয়ার! কবে থেকে? কখন? সহসাই উত্তেজিত হয়ে পড়েন মনোবিজ্ঞানী ফায়েজ।
বিয়ের পর এই বাড়িতে পা দেয়া অব্দি। সময়ের কথা বলছেন- অবশ্যই রাতে।
ও আই সি। বিষয়বস্তু কী একটু বলবেন ? মানে যতটা বলা যায়- পীড়াপীড়ি করেন ফায়েজ। কোনভাবে প্রকৃত সত্যিটা তাকে টেনে বের করতে হবে।
শায়লা চুপ। সারা ঘরে পিনপতন নীরবতা। ফায়েজ রুদ্ধশ^াসে অপেক্ষা করেন। প্রতিপক্ষকে তা বুঝতে দেন না। যেন তার ব্যস্ততার কিছু নেই। শায়লাকে স্পেস দিতে হবে। তাড়াহুড়োয় খোলস গুটিয়ে নিলে আর হল না। সব গুবলেট পাকিয়ে গেল।
ওদিকে পর্দার আড়ালে উৎকর্ণ হয়ে আছেন আফসার। কিছু শুনতে চান তিনি। শায়লার মুখ থেকে। আপসোস, মেয়েটা তাকে নিজেই সব বলতে পারতো। তাহলে আর ঘরের কথা পাঁচকান হত না। তাও ভাল, শায়লা ওদের নিরাশ করে নি। স্বপ্নের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলল, রক্তেভেজা একটা বালিশ- নাইলনের দড়ি- বাঁচার তীব্র আকুতি ও মধ্যবয়সী এক নারীর লাশ!
লাশ! সত্যি দেখেছেন? কে সে ? আপনি তাকে চেনেন ? ফায়েজ যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়তে চান। বারবার জানতে চান শায়লা তাকে চেনে কি না। ইন এনি কেস, আগে কখনও দেখেছে কি না।
ব্যস, শায়লা অমনি মুখে কুলুপ এঁটে নিয়েছে। আর কিছু জানা গেল না। অতৃপ্ত ফায়েজ একসময় উঠে পড়েন। পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন আফসার। শায়লার অজান্তে।
দিনকয়েক বাদে আবারও উসখুস করেন আফসার। জানতে চান, ফায়েজ, কিছু বুঝলে ?
অপেক্ষা করো বন্ধু। সবুরে মেওয়া ফলে। এখনও সময় হয় নি। ফায়েজের ঠোঁটে নির্বিকার পরিমিত হাসি।
আরো দিন দশেক কাটলো। ফায়েজ হঠাৎ বললেন, তুমি আমার কাছে সত্যগোপন করেছ আফসার। পুরোটা ভেঙে বলো নি। এবার বলো আসল সত্যিটা কী ?
ফায়েজের কথায় কেমন মিইয়ে যান আফসার। বুঝতে পারেন না, ঠিক কী জানতে চায় ফায়েজ। নাকি পারিবারিক কেচ্ছা গোপন রাখাই সমীচীন! তাতে আখেরে যা হয় হোক।
ফায়েজ অবশ্য লুকোছাপার ধারেকাছে গেলেন না। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে কষা গলায় বললেন, তোমার মায়ের মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না, তাই না আফসার! তিনি খুন হয়েছেন।
মানে ? তুমি কী বলতে চাও ফায়েজ? নেহাতই বন্ধু বলে যা নয় তাই - । কথা শেষ করেন না আফসার। কী কী সব বিড়বিড় করেন। পরে অবশ্য ফায়েজের জ¦লন্ত চোখের সামনে হার মানতে বাধ্য হন। স্বগতোক্তির মতো বলেন, আসলে তখন আমি এত ছোট ছিলাম যে -- ।
এবারেও অসমাপ্তই থেকে যায় আফসারের বক্তব্য। ফায়েজ ওর চেম্বার থেকে উঠে যেতে যেতে বলেন, তুমি বাড়িটা বরং বেচে দাও আফসার। ওখানে শাপ আছে।
আপাতত এটুকুই। আফসার শুধু ভেবে পায় না, ফায়েজ কি করে তার মায়ের মৃত্যুরহস্য জানলো! শায়লা কি কিছু বলেছে! অসম্ভব। শায়লা তো এ-কথা জানে না। নাকি কোন অসতর্ক মুহূর্তে তিনি নিজে থেকেই বলেছেন! আফটার অল, মানুষ তো। ইন্দ্রিয়ের উপর কতটাই বা নিয়ন্ত্রণ থাকে।
যাকে গে, বন্ধুর পরামর্শে আফসার এখন পত্রিকার অফিসে যাচ্ছেন। বাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেবেন। তারপর শায়লাকে নিয়ে অন্য কোথাও- যেমন হোক নতুন কোন বাসাটাসা দেখবেন।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top