সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১


অবিস্মরণীয় : অর্ঘ্য ঘোষ


প্রকাশিত:
৯ আগস্ট ২০২০ ২৩:২৯

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ০৫:০৮

 

বৈঁচির মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে পড়ল। বৈঁচি আমাদের একমাত্র সন্তান। আমাদের মানে আমার আর সূচির। গ্রামের হাইস্কুলে মাস্টারি পাওয়ার পরই সূচি আমার জীবনে এসেছিল। উড়ে এসে জুড়ে বসে নি। রীতিমতো সাদরে বরণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল। দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে মা লক্ষ্মীর চরণচিহ্ন আঁকতে আঁকতে গৃহপ্রবেশ করেছিল। সূচি আসার বছর চারেক পর এসেছিল বৈঁচি। সেই বৈঁচির জীবনের প্রথম বড়ো পরীক্ষা।
আমাদেরই স্কুল থেকে পরীক্ষা দেবে। সেন্টার পড়েছে তিরিশ কিলোমিটার দূরের সাঁইথিয়া শহরে। যাতায়াতের মাধ্যম বলতে কিলোমিটার পাঁচেক ভ্যান কিম্বা রিক্সায় কলেশ্বর মোড়ে গিয়ে বাস। কিন্তু প্রতিদিন ওইভাবে যাওয়া আসা করে পরীক্ষা দেওয়াটা ছেলেমেয়েদের পক্ষে হয়রানির পাশাপাশি চরম ঝুঁকির ব্যাপারও বটে। রাস্তা এবং বাসের যা অবস্থা সবদিন সময়মতো পৌছোবে কিনা সন্দেহ। তাই পরীক্ষার্থীরা কাছাকাছি কোন আত্মীয়বাড়ি খোঁজে , নয়তো কয়েকজন মিলে ঘর ভাড়া করে থেকে যায়।
         
সাঁইথিয়া শহরের কাছাকাছি আমাদের কোন আত্মীয় বাড়ি নেই। ভেবেছিলাম কোন হোটেলের ঘর ভাড়া করে বাপ-বেটিতে থেকে যাবো। কয়েকটা দিন অপার স্বাধীনতা আর দিব্যি ঝালেঝোলে কাটিয়ে দেব। কিন্তু সেই ভাবনা বরবাদ করে দেয় জুঁই। জুঁই বৈঁচির প্রাণের বান্ধবী। সেই রান্নাবাটি খেলা থেকে সই। মাঝেমধ্যে ওদের বাড়িতে থেকে যায় বৈঁচি। জুঁইয়ের বাবা-মা বৈঁচিকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। জুঁইয়েরও এ বাড়িতে অধাধ গতি। তারাও জুঁইকে সমদৃষ্টিতে দেখেন। জুঁইই তাদের এক আত্মীয় বাড়িতে থেকে দুই সখীর পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।

 জুঁইয়ের মা নন্দিনী আর সূচি একদিন গিয়ে সেই বাড়ি দেখেও এসেছে। তারা তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গৃহকর্ত্রী বিধবা। দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়ে শিক্ষিকার চাকরি পেয়েছেন। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বিরাট বাড়িতে একাই থাকেন। তাঁর মতো অমন ভালো মানুষ নাকি আর হয় না। মেয়েটিও এবার বৈঁচিদের সঙ্গেই এক সেন্টারে থেকে পরীক্ষা দেবে। প্রথমে ঠিক ছিল আত্মীয়বাড়িতে থাকা হলেও খাওয়া দাওয়া সব হোটেলে করবে। বিশেষ করে বৈঁচির একজন অনাত্মীয়ের বাড়িতে টানা পনেরো দিন খাওয়াদাওয়াটা মোটেই ভালো দেখাই না। কিন্তু ভদ্রমহিলা নাকি কোন কথা কানেই তোলেন নি। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন , ‘ আমার বাড়িতে থাকতে হলে বাইরে খাওয়া চলবে না। আমি জানবো আমার তিনটি মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। একটা মেয়েকে যদি রেঁধে বেড়ে দিতে পারি তাহলে বাকি দুটোকেও পারবো। ’
শেষমেষ সূচি খাওয়ার খরচ নেওয়ার কথা তুলতেই ভদ্রমহিলা হাত জোড় করে বলেন , ‘ আপনারদের গুরুজনের আর্শিবাদে আমাদের অভাব কিছুই নেই। দয়া করে টাকা নেওয়ার কথা বলে আমাকে বিড়ম্বনায় ফেলবেন না। ’

সূচি আর কিছু বলতে পারে নি। স্ত্রী’র মুখে সব শুনে আমিও অবাক হই , ‘ সত্যি আজকের দিনে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। বিশেষ করে শহরের মানুষ অনাত্মীয়কে খেতে থাকতে দিতে খুব কাতর। অবশ্য তাদের খুব একটা দোষও দেওয়া যায় না। আসলে তাদের তো জল থেকে নিমপাতা সবই কেনা। ’
টাকা না নিলেও , শেষ পরীক্ষার দিন মা-মেয়ের জন্য কিছু একটা উপহার কিনে দিয়ে আসব বলে মনে মনে ভেবে রাখি। সূচি চেয়েছিল আমি ওই সেন্টারে গার্ড নিই । আমাদের স্কুলে মাস্টারমশাইদের ছেলেমেয়েরা যেবার পরীক্ষা দেয় সেবার তারা ওই সেন্টারে গার্ড নেন। তা নিয়ে নানা রকম গুঞ্জন ওঠে। তাও কেউ কানে তোলেন না। কিন্তু নীতিনৈতিকতার প্রশ্নে আমি তা পারি না। আমি একজন অভিভাবক হিসাবেই পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতে চাই। বাড়ি থেকেই খাওয়া দাওয়া করে সেন্টার অভিমুখে রওনা দিই।
            
প্রথমদিন আমি পৌঁছোনোর আগেই বৈঁচিরা পৌঁচ্ছে যায়। দূর থেকেই তাদের দেখতে পাই। কাছে যেতেই বৈঁচি আর জুঁইয়ের সঙ্গে যে মেয়েটি  এগিয়ে আসে তাকে দেখে বৈঁচিরা যে ওদের বাড়িতেই থাকে বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার। বৈঁচিই আলাপ করিয়ে দেয় অন্তরার সঙ্গে। ভারি মিস্টি মেয়ে , এরই মধ্যে বৈঁচিদের কেমন আপন করে নিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন তিন বান্ধবী। মায়ের সম্পর্কে সূচীর মুখে যা শুনেছে মেয়েও মনে হচ্ছে সেই ধারা পেয়েছে। আলাপ পরিচয়ের পর সবাইকে পরীক্ষা সম্পর্কিত কিছু উপদেশ দিই। তারপর ওরা আমাকে প্রণাম করে পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকে যায়।

পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অখণ্ড অবসর। পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরেটা একটা মজার জগত। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা উপলক্ষ্যে কত রকম যে মানুষ আসেন তার ঠিক নেই। অধিকাংশই গভীর উদ্বেগে থাকেন। মনে হয় যেন ছেলেমেয়েদের নয় , তাদেরই পরীক্ষা হচ্ছে। তাই উদ্বেগ কিম্বা সময় কাটাতে কেউ তাস , কেউ লুডো নিয়ে বসে পড়েন। কেউ বা দিব্যি আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন। চেনা নেই , জানা নেই অথচ সবাই কেমন যেন একাত্ম হয়ে যান। পরীক্ষা শেষের দিন মন ভারক্রান্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ ঠিকানা ,ফোন নং আদানপ্রদান করেন। আগে গার্ড দিতে এসে ছবিটা আমার চেনা হয়ে গিয়েছিল। তাই সময় কাটানোর জন্য বাড়ি থেকে ঝোলায় ভরে গল্পের বই এনেছি। একটা গাছতলায় সেটাই খুলে বসি। পাতা উল্টায় আর গল্পগুজব করি। ওই করেই সময় কেটে যায়। পরীক্ষা শেষে মেয়ে তিনটিকে দোকানে নিয়ে গিয়ে টিফিন করায়। কে কেমন লিখেছে,  খোঁজখবর নিই। তারপরেই শুরু হয়ে যায় আমার বাড়ি ফেরার তাড়া। অন্তরা তাদের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য আবদার ধরে। পরদিন যাবো বলে কোনরকমে ছাড় পাই।

প্রতিদিনই একই ঝোঁক ধরে অন্তরা। আমিও আজ নয় কাল করে কাটাই। ওইভাবেই একে একে শেষ হয় পরীক্ষা। শেষ পরীক্ষার দিন আর এড়িয়ে যাওয়া চলে না। জিনিসপত্র গুটিয়ে বৈঁচিদের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার আছে। জুঁইয়ের বাবা-মা’ও আমাকে সেই দায়িত্ব দিয়েছেন। সেইজন্য সূচির সঙ্গে আলোচনা করে অন্তরার জন্য একটা সালোয়ার কামিজ আর তার মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনে নিই।

বাড়ি ঢোকার আগে প্যাকেট অন্তরার হাতে দিতেই সে অনুযোগ করে , ‘ কাকু এটা আপনি ঠিক করেন নি। মা কিন্তু খুব রাগ করবেন। আপনি কিন্তু নির্ঘাত আজ মায়ের কাছে বকুনি খাবেন। ’
আমি হেসে বলি , ‘ কি করবো অন্যায় যখন করেই ফেলেছি তখন তো বকুনি খেতেই হবে।’
‘ বেশ তাহলে বকুনি খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন। ’
আমাকে বসার ঘরে বসিয়ে রেখে বৈঁচিদের নিয়ে হাসতে হাসতে ভিতরের দিকে চলে যায় সে।

আমি ঘরের চার দেওয়ালে চোখ বোলাতে থাকি। পরিপাটি করে সাজানো ঘর। আলামারি ভর্তি , দেওয়ালে মণিষীর ছবি। সর্বত্র একটা পরিচ্ছন্ন রুচির ছাপ।
ওইসব দেখতে দেখতে নিবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। মগ্নতা ভাঙে নারী কন্ঠে , ' কেমন আছো ? ' সম্বোধন শুনে আশ্চর্য হয়ে যায়। চেনা নেই , শোনা নেই আচমকা তুমি করে কথা বলা কি ধরণের সৌজন্য ? ঘাড় ঘুরিয়ে মহিলার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকি।
' কি চিনতে পারলে না তো ? আমি কিন্তু ভিতরের ঘর থেকে এক পলকেই চিনেছি। অতো বড়ো মেয়ের বাবা হলে কি হবে চোখ মুখ সেই একই আছে। '
আমি অবাক হয়ে মহিলার মুখের দিকে চেয়ে চেনার চেষ্টা করি। আস্তে আস্তে স্মৃতির পর্দার আস্তরণ সরে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক টগবগে অষ্টাদশীর সুশ্রী মুখ , ' পারুল না ? '
' যাক ভোল নি , চিনেছো তাহলে ? '

ভোলা কি যায় ? এক লহমায় চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় অতীত। আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। আমাদের সেন্টার পড়েছিল ময়ূরেশ্বরে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল আরও খারাপ। সেন্টারের কাছাকাছি থেকে পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। কিন্তু ময়ূরেশ্বরে থাকার মতো কোন জায়গা ছিল না। বন্ধু দেবাশিস তার এক আত্মীয়কে ধরে শ্যামল ডাক্তারের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। শ্যামল ডাক্তারেরই একমাত্র মেয়ে পারুল। স্মৃতির পাতা উল্টোতে থাকে। একে একে সব মনে পড়তে থাকে। পারু তাগাদা দেয় , ' কি মনে পড়েছে ? '
' মনে না পড়ে উপায় আছে ? যা করেছিলে তুমি ? '
' কি করেছিলাম ? '
' যেদিন প্রথম এসেছিলাম সেদিন কড়া নাড়তেই তুমি তিনতলার বারন্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলে। আমরা বাক্সপ্যাটারা নিয়ে ঠাই রোদে। আমরা যত বলি ' এটা কি শ্যামলবাবুর বাড়ি ? তুমি তত বলো কোন শ্যামলবাবু ? আমরা বলি ডাক্তার। তুমি ফের জিজ্ঞাসা করো , কিসের ডাক্তার ? মানুষের না পশুর ? আমরা বলি , মানুষের। তুমি জিজ্ঞেস করো , শরীরের না মনের ? গোটাপাড়া শুনতে  পেলেও তুমি শুনতে না পাওয়ার ভান করে এক একটা কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনবার করে জিজ্ঞেস করছিলে। রোদে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে জবাব দিতে দিতে ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল। আচ্ছা মেয়ে ছিলে যাহোক। সুযোগ পেয়ে রীতিমতো র‍্যাগিং করে নিয়েছিলে। '
পারু হো হো করে হেসে ওঠে, 'ওফঃ সে এক কান্ড হয়েছিল বটে। তোমরা গ্রাম থেকে এসেছিল। একটু ভোলেভালে গোছের ছিলে। তোমাকে তো দেবদাস মার্কা দেখতে ছিল। তাই মজা করার দুষ্টুবুদ্ধি চেপেছিল। নতুন এলে স্কুল-কলেজে র‍্যাগিংই তো হয়। '
' র‍্যাগিং সেদিন কতক্ষণ চলত কে জানে ? নেহাৎ মাসীমা এসে উদ্ধার করলেন তাই। মাসীমা - মেসোমশাই কেমন আছেন ? '
' তারা তো আর কেউ ইহলোকে নেই। আমার বিয়ের  পরেই দু'বছরের ব্যবধানে চলে যান। অন্তরা জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় পথ দুর্ঘটনায় ওর বাবাও চলে যায়। সেই থেকে মেয়ে আর চাকরিটা নিয়ে বেঁচে আছি। চাকরি জন্যই একদিন মেয়ের পরীক্ষায় সেন্টারে যেতে পারি নি। '
পারুলের গলা ভারি হয়ে আসে। চোখের কোন চিকচিক করে ওঠে। আমি সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাই না। মাসীমা - মেসোমশাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। ভারী ভালোমানুষ ছিলেন তাঁরা। মাসীমার তো তুলনাই হয় না। পারুর দুষ্টুমির হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করতেন। নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে যখন প্রণাম করতাম তখন পারুর মতোই কপালে দই হলুদের ফোঁটা আর মাথায় ঠাকুরের প্রসাদীফুল ছুঁইয়ে আর্শিবাদ করতেন। মেসোমশাই চেম্বার থেকে ফিরে প্রতিদিন কেমন পরীক্ষা হচ্ছে , কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা খোঁজ নিতেন।

তাদের কথা ভেবে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। পারুও চুপ করে থাকে। স্বাভাবিকতা ফেরাতে বলি , ' তোমাকে এখানে দেখব ভাবতে পারি নি। '
' আমিও কি ভেবেছিলাম নাকি ? '
' কি আশ্চর্য ব্যাপার দেখো , তোমাদের বাড়িতে থেকে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছিলাম আমি। আর তোমার শ্বশুরবাড়ি থেকে দিলো আমার মেয়ে। '
' ভাগ্যিস দিলো , তাই তো দেখা হলো। '
কথাটা পারু এমন ভাবে বলল যেন দেখা না হলে জীবনের একটা অধ্যায় অস্পূর্ণ থেকে যেতো।

সেদিন আর ফিরতে দেয় না পারু।  ততক্ষণে আমাদের পূর্বপরিচয়ের ব্যাপারটা মেয়েদের জানা হয়ে গিয়েছে। তারাও সেইসব গল্প শোনার আবদার করে। অগত্যা তাদের সামনেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসতে হয়। পারুই কথা শুরু করে , ' শুধু র‍্যাগিংএর কথায় মনে রেখেছো ? আর কিছু মনে নেই ? '
' আর কিছু কি ? '
' কেন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে নি ? '
' ও বাবা তোমার বন্ধুত্ব নিয়ে আমাদের দুই বন্ধুর গোপন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেবাশিস তোমাকে সাজেশন বই দিলে আমি নোটস দিতাম। পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময় ও তোমার জন্য তিলেখাজা আনলে আমি চকলেট । '
' ও সে একটা মজার ব্যাপার হয়েছিল বটে। তোমরা দু'জনেই ভেবে নিয়েছিলে আমি বুঝি প্রেমে পড়ে গিয়েছি। খুব উপভোগ করতাম। আমার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে দেখতাম তোমাদের। আমিও সেই সুযোগ দিতাম। '
' তার মানে তুমি আমাদের দু'জনকেই খেলাতে বলো ? '
' ওভাবে বলছো কেন ? আমি তোমাদের দু'জনকেই বন্ধু ভাবতাম। তবে সত্যি বলতে কি তোমাকেই বেশি পচ্ছন্দ করতাম। কেমন দেবদাস - দেবদাস দেখতে ছিলে তুমি।  চাউনিটাও কি সাংঘাতিক ? যে দেখতো সে'ই ঘায়েল। তোমার বন্ধুটির আবার যাত্রাদলের বিবেকের মতো চুল। কথা বলতো যাত্রার ঢঙে। আমার দু'চোখের বিষ। '
' কিন্তু তোমাকে দেখে তো মনে হোত না। '
' সেই মন নিয়ে দেখেছো কখনও ? '

মেয়েদের সামনের পারুর কথায় খুব লজ্জা পাই আমি। পরক্ষণেই ভাবি , ওরা তো সব বড়ো হয়ে গিয়েছে। বড়ো হলেই ছেলেমেয়েরা বন্ধুর মতো হয়ে যায়। তখন তাদের সামনে পুরনো রোমান্সের কথা বলা যেতেই পারে। মেয়েদের মুখের দিকে চেয়ে দেখি তারাও সব কৌতুকের দৃষ্টিতে আমাদের মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে। বুঝতে পারি ব্যাপারটা তারা খুব উপভোগ করছে। বৈঁচি আর কৌতুহল চেপে রাখতে পারে না , 'তোমাদের প্রেম হলে বেশ হতো না ! '
অন্তরা সংযোজন করে , 'তাহলে সব অন্যরকম হতো। তখন হয়তো আমাকেই পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তোদের বাড়ি যেতে হতো। '
জুঁই চিন্তিত ভাব করে বলে, ' তাহলে আমিই মুসকিলে পড়তাম। তখন আমি কার বন্ধু হতাম কে জানে! '

তার কথায় সবাই হেসে ওঠে। কথা আর ফুরোয় না। কথায় কথায় রাতে বাড়ে। পারু তাড়া দিয়ে সবাইকে ঘুমোতে পাঠায়। কিন্তু আমার আর ঘুম আসে না। পারুর কথাগুলো মনে পড়ে। সত্যিই কি অন্যরকম হয়ে যেত জীবনধারা ?

পরদিন সকালে বিদায় নেওয়ার আগে একান্তে পারু আমার হাত ধরে সেই কথাটাই বলে , ' আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো না ? '
' অন্যরকম হওয়ার আভাস তো তুমি দাও নি। '
' দিয়েছিলাম তুমি বোঝ নি। তোমার কথা মতোই আমি কলেজে বাংলা অর্নাসে ভর্তি হয়েছিলাম। তুমি এলে না কেন ? '
' আমার কথা মতো ? '
' তোমার কথা মতো নয় ? বা রে ভুলে গেছ ? '
আলমারি খুলে একটা বই বের করে আনে পারু। বইটা দেখেই আমি চমকে যাই।  জীবনানন্দের ' বনলতা সেন। ' আমার খুব প্রিয় বই। পরীক্ষা দিতে আসার সময় নিয়ে এসেছিলাম। যাওয়ার দিন পারুকে গোপনে উপহার দিয়ে যাই। তারই শেষ পাতায় লিখে দিয়েছিলাম ' কলেজে বাংলা অর্নাসে ভর্তি হোয়ো। আমি আসব। '
চোখের সামনে সেই লেখা জ্বলজ্বল করে ওঠে। সব মনে পড়ে যায়। আসব বলেও আসা হয় নি। কারণ সেবারে আমরা দুই বন্ধুই ফিজিক্সে ব্যাক পেয়ে যাই। অথচ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় পারুদের বড়ো মুখ করে বলে এসেছিলাম , ' হাই সেকেন্ড ডিভিশন তো পাবোই। ফার্স্ট ডিভিশনও হতে পারে।' তাই লজ্জায় আর মুখ দেখাতে যেতে পারি নি। সব থেকে বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছিল পারুর ভাই দেবেশ। বইয়ের দোকান থেকে আমরা যখন বুকলেট দেখে মুখচুন করে বেরোচ্ছি তখন দিদির রেজাল্ট নিতে ঢোকে সে। তার মুখেই জানতে পারি পারু সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছে। আমরাও ব্যাক পাওয়ার কথা চেপে গিয়ে বলি, ' হাই সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছি। '
দেবেশ সেদিন বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব জোরাজুরি করছিল। কিন্তু এক প্যাকেট সন্দেশ কিনে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ব্যস্ততার অজুহাতে আমরা পালিয়ে বাঁচি। পরের বছর পাশ করলেও আর সাঁইথিয়াতে ভর্তি হওয়া হয়নি। অন্য কলেজে যেতে হয়েছিল। মনে মনে ভাবি , ' সেদিন যদি ব্যাক না পেতাম তাহলে হয়তো জীবনধারাটা সত্যিই অন্যখাতে বইয়ে যেতো। '
নিজের লেখাটাতে হাত বোলাতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে উঠি, ' আজও সেই সব মনে রেখেছো ?  '
পারু অবরুদ্ধ গলায় বলে , ' কিছু কিছু কথা সারাজীবন মনে থেকে যায়। কিছুতেই ভোলা যায় না। '
আমিও মনে মনে বলি, 'সত্যিই ভোলা যায় না। '

 

অর্ঘ্য ঘোষ
বীরভূম, পশ্চিম বঙ্গ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top