সিডনী মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল ২০২৪, ৩রা বৈশাখ ১৪৩১


আশ্রয় : পৃথা সিনহা দাস


প্রকাশিত:
৩ অক্টোবর ২০২০ ২১:৩৬

আপডেট:
৫ অক্টোবর ২০২০ ২২:৪৪

 

'আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারো,
আরো কঠিন সুরে জীবন - তারে ঝঙ্কারো।।
যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে বাজেনি তা চরম তানে,
নিঠুর মূর্ছনায় সে গানে মূর্তি সঞ্চারো'।।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবা মশাইয়ের উদাত্ত কন্ঠের রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছিল মৈথিলী। আকাশে বাতাসে অনুরণিত হচ্ছিল সুরের মূর্ছনা। গান শেষ হতেই ঘরের ভিতর ঢুকলো সে।

মৈথিলী--  " বাবা মশাই.... তোমার চা এনেছি।"

তানপুরাটা  পাশে সরিয়ে মৈথিলীর বাবা মশাই রজতশুভ্র ব্যানার্জী উঠে দাঁড়ালেন।ছ ফুট দু ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটিকে মৈথিলীর মনে হয় যেন এক প্রাচীন বটবৃক্ষ।তার মুখের সফেদ শ্মশ্রু, কাঁধ ছাড়িয়ে নামা চুল যেন বটের ঝুরি।

বাবা মশাই--  " তোর হাতের চা না খেলে সকাল টা যেন শুরু ই হতে চায় না রে"।

একটা ভালো লাগার হাসি খেলে গেল মৈথিলীর ঠোঁটে।

মৈথিলী---  " তুমি চা খাও, আমি একটু বাগান থেকে ঘুরে আসছি। "

চা খেতে খেতে জানালা দিয়ে রজতশুভ্র মৈথিলীকে  লক্ষ্য করছিলেন। এক উচ্ছ্বল নদী যেন, আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে। এই পরিবেশের সাথে, এই প্রকৃতির সাথে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছে। সেদিনের সেই রাতের কথা আজও রজতশুভ্রর মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিশেষ একটি কাজে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন। কাগুজে নিয়মের বেড়াজালে আটকে গিয়ে, কাজটি হতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল, ততক্ষণে গুটি গুটি পায়ে বেলা পশ্চিম আকাশ পানে এগিয়ে গেছে অনেকটা। রজতশুভ্রর ঘরে ফেরার কোনো উপায় ছিল না আর সেদিন। তার গন্তব্য... ছোট্ট পাহাড়ি অঞ্চলের শেষ ট্রেন টি হাওড়া স্টেশন ছেড়ে  ততক্ষণে বিকেলের হলদেটে আলো গায়ে মেখে পৌঁছে গেছে তার ঠিকানায়। অগত্যা.... দক্ষিণ কলকাতায় এক বন্ধুর ঠিকানায়  রাত কাটাবেন স্থির করলেন। হোটেলে থাকার মত পকেটের রেস্ত তার ছিল না।

মুখার্জী ম্যানসনের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামতেই বাড়ির গেটে অপেক্ষা রত সুবিমল মুখার্জী এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন রজতশুভ্র কে। নিজের আসার কথা ফোন করে বন্ধু কে জানিয়েছিলেন রজতশুভ্র।বহু বছর পর সাক্ষা ঘটল দুই বন্ধুর। সুবিমলের সাথে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে ,সুসজ্জিত বসার ঘরের সোফায় গিয়ে বসলেন রজতশুভ্র।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে ঘরে আগমন ঘটল একটি অল্প বয়সি বিধবা মেয়ের। বড় স্নিগ্ধতা তার চেহারায়। তার শ্বেত শুভ্রবসন সেই স্নিগ্ধতায় যেন শান্তির প্রলেপ। তবে.....তার চারপাশে পাকখাচ্ছে মনখারাপিয়া বাতাস। তার দীঘল চোখে অব্যক্ত যন্ত্রনা।

"এতদিনে মনে পড়ল আমাদের? সব ছেড়েছুঁড়ে এমন বনবাসী হলেন কেন? সবই তো মিটে গেছে "।

মেয়েটির পিছনেই ছিলেন সুবিমলের স্ত্রী জয়ন্তী। রজতশুভ্র খেয়াল করেননি। জয়ন্তীর বলা কথাগুলো রজতশুভ্রর অন্তঃস্থলে ঘাপটি মেরে থাকা একটা জমাট কালো কে ছুঁয়ে দিল, সেই কালো থেকে কষ্ট, অভিমান, রাগ চুইয়ে চুইয়ে পড়তে লাগলো।

"এই মেয়েটিকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না"......জয়ন্তীর কথাগুলো কে উপেক্ষা করে রজতশুভ্র ট্রে বহনকারিনী সম্পর্কে জানতে চাইলেন।

"ও আমার দিদির মেয়ে মৈথিলী। বিয়ের একবছরের মধ্যে স্বামীকে খেয়েছে। শ্বশুর, শাশুরির অত্যাচার, লম্পট দেওরের কুনজর টিকতে দিল না ওকে ওই বাড়িতে। এক কাপড়ে শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিদি জামাইবাবু ও ইহলোকের মায়া ত্যাগ

করেছে প্রায় পর পর। আমাকেই আশ্রয় দিতে হল বাধ্য হয়ে"। একনাগাড়ে, বিরক্তি সহকারে কথাগুলো বলে থামলো সুবিমল। সবার হাতে খাবারের প্লেট তুলে দিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মৈথিলী। ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলেন রজতশুভ্র। মৈথিলীর প্রতিটি পদক্ষেপ যেন শৃঙ্খলিত। সেই  শিকল, নিজের ভবিতব্যের,মানিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার, সময়ের সাথে আপোষ করে চলার  শিকল।

রাতের আহার পর্ব চুকিয়ে ,তার জন্য নির্ধারিত শয়নকক্ষে এসে নিদ্রা দেবীর আরাধনার তোড়জোড়  করছিলেন রজতশুভ্র। হঠা.... কাচের কিছু ভাঙার ঝন্ ঝন্ শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা খান্ খান্ হয়ে গেল। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে, জয়ন্তীর চাপা গলার আওয়াজ অনুসরণ করে রজতশুভ্র পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।

"ভাঙলি তো এত দামি প্লেট টা। নিজের সুখ খেয়েছিস, এখন আমার সংসারের ওপর নজর পড়েছে।"    জয়ন্তীর বাক্য বাণে জর্জরিত মৈথিলীর গালে সপাটে এসে পড়ল একটি চড়। রজতশুভ্রর কানে এসে পৌঁছালো সেই শব্দ। " আজ তোর রাতের খাওয়া বন্ধ"। বলেই হনহনিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল জয়ন্তী অন্ধকারে দাঁড়ানো রজতশুভ্র কে খেয়াল না করেই।

মাটিতে ছড়ানো কাচের টুকরোগুলো একজায়গায় জড়ো করছিল মৈথিলী। ভাঙা কাচের ওপর ঝরে পড়ছিল ভাঙা মনের কষ্ট টুপটাপ করে। এই শব্দহীন পতনের সাক্ষী রাতের আঁধার, রান্নাঘরের বাসনপত্র, অভুক্ত মৈথিলীর অপেক্ষারত একমুঠো ভাত আর রজতশুভ্র।

"আমার সাথে যাবি? এই দুঃখের জীবনের থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছে করেনা তোর?  আপাত চাকচিক্যময় অট্টালিকার অভ্যন্তরে ঘুণে ধরা জীবনের থেকে এই বুড়োটার কুঁড়েঘরে স্বাধীনভাবে আনন্দে থাকবি। প্রথম সাক্ষা এই কেমন এক মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে গেছি রে তোর সাথে।

মাথার ওপর একটা স্নেহের স্পর্শ পেয়ে মৈথিলী অনুভব করল, তার জমে থাকা কষ্টের পাহাড় কেমন গলে গলে যাচ্ছে, দুঃখ গুলো নোনা জলে মাখামাখি হয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে তার বুক। সাহচর্যের বাতাস আঘাত হানছে তার মনের বন্ধ দ্বারে। দুঃসময়ের পাথর চাপা তার আমিটা এবার মুক্তি চায়।

"আমি যাব আপনার সাথে। এ জীবন শুধু ভাঙন দেখেছে, শুধু হারিয়ে যাওয়া দেখেছে.... এবার না হয় কিছু গঠন হতে দেখুক.... কিছু খুঁজে পাক বাঁচার রসদ হিসেবে।"

সকাল হওয়া মাত্র সুবিমলের কাছ থেকে অতি সহজেই মৈথিলীকে নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেল। এত সহজে ঘাড় থেকে বোঝা নামাতে পেরে সস্ত্রীক সুবিমল মুখার্জী যারপরনাই খুশি হলেন, অবশ্য দু ফোঁটা কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করতেও ভোলেননি তারা। নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল মৈথিলী এক নতুন সকালে।

ট্রেন এসে থামল একটি ছবির মত ছোট্ট স্টেশন সাহেবগঞ্জে। রজতশুভ্রর সাথে মৈথিলী ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালো। সূর্যদেব  তখন মধ্য গগনে শোভা পাচ্ছেন। শীতের বার্তাবাহক বাতাসে এই মাঝবেলাতেও একটা শিরশিরানি। দূরের ঢেউখেলানো পাহাড়শ্রেণীর মাথায় জমে আছে  উদাসী মেঘ। রুখাসুখা পথ এঁকে বেঁকে চলেগেছে দূর থেকে বহুদূরে।

"ও বাবামশাই ঘর যাবে নাকি?"

একজন আদিবাসী পুরুষের ডাকে রজতশুভ্র সাড়া দিয়ে বললেন...

"হ্যাঁ রে বুধন বাড়ি যাব। তোর রিক্সা পাওয়া যাবে?"

রজতশুভ্র মৈথিলীকে নিয়ে বুধনের রিক্সায় চেপে বসলেন।

"দেখ বুধন, এই হল আমার মেয়ে। প্রথমবার বাপের ঘরে এসেছে। সাবধানে রিক্সা চালাস। তোর গা থেকে যা সুগন্ধ বেরিয়েছে.... বেশ বুঝতে পারছি সকাল থেকেই মহুয়া খেয়ে টঙ হয়ে আছিস"।

মৈথিলী অবাক চোখে দেখছিল তার পাশে বসা মানুষটিকে। কি সহজে তার মত অচেনা একজন কে নিজের মেয়ের আসনে বসিয়ে দিলেন। মৈথিলী সিক্ত হচ্ছিল অন্তরে। বহুদিনের স্নেহ, মায়া মমতাহীনতার রুক্ষ প্রান্তর আর্দ্র হয়ে উর্বর হচ্ছিল নতুন আশার চারা রোপণের তরে।

ছোট্টো যায়গা সাহেবগঞ্জ। এখানকার সবাই রজতশুভ্র কে বাবামশাই বলেই ডাকে। তিনকামড়ার বাড়িটি কে মৈথিলী পরম যত্নে সাজিয়ে তুলেছে। রজতশুভ্রর অগোছালো সংসারে এখন পরিপাট্টের ছোঁয়া। বাইরের ঘরে তার দাতব্য চিকিসালয়ে দিনরাত গরীব অসুস্থ মানুষের যাতায়াত লেগেই আছে। তাদের কাছে বাবামশাই ভগবান তুল্য। তার দেওয়া ওষুধ খেয়ে মরণাপন্ন মানুষ যমের দুয়ার থেকে ফিরে আসে.... গরীব মানুষগুলোর এই বিশ্বাস দেখে রজতশুভ্র আরও ভীষণ ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন ঐ দুস্থ, অসহায় মানুষগুলোর অনুভূতির সাথে।

রোগীর ভিড় বেশি হলে নাওয়া খাওয়া ভুলতে বসা রজতশুভ্র কে এখন অনিয়মের বদভ্যাস মুক্ত করেছে মৈথিলী। মৈথিলী তার সহকারী ও বটে। এককথায়, বাপমেয়ের সংসার জমজমাট এই সব ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে।

"বাবামশাই... বাইরের ঘরে অনেক রোগী এসেছে,তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। কী এত ভাবছো?"

মৈথিলীর কন্ঠস্বরে চমকে উঠলেন রজতশুভ্র। আতীত সড়নি ধরে হেঁটে গিয়েছিলেন অনেকটা পিছনে। বর্তমানের ডাকে ফিরে এলেন বাস্তবভূমে।

  " যাচ্ছি রে মা"....

মৈথিলী বুঝতে পারে বাবামশাই তার কথা ভেবেই মাঝে মাঝে উদাস হয়ে যান। মেয়ের ভবিষ্যৎ কে নিরাপত্তা দিতে চায় তার পিতৃহৃদয়। কিন্তু.... মৈথিলী যে স্থির করে নিয়েছে আর সে বাঁধা পড়বে না কোনো বন্ধনে। নতুন সম্পর্ক মানেই আবার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। মুখবন্ধের পর নতুন গল্প লেখা শুরু। যদি সে গল্প অনুভূতিহীন হয়.... যদি সে গল্পের পরতে পরতে থাকে বৈচিত্র্যহীনতা... সময়রূপী,সমাজরূপী পাঠকের মনোরঞ্জনের তাগিদে এ কেবলই টেনে হিঁচড়ে দীর্ঘায়িত করার কারণে সে গল্প যদি হয়ে পড়ে প্রাণহীন....

মৈথিলীর জীবন এখন পরিপূর্ণ, বাবামশাইয়ের স্নেহে, সাহেবগঞ্জের প্রকৃতির সান্নিধ্যে, এখানকার সরল সাধাসিধে মানুষগুলোর মুখে  মৈথিলী কে নিজেদের মত করে 'মৈলী দিদি' ডাক শুনে।

সাহেবগঞ্জের প্রকৃতির অকৃত্রিম সৌন্দর্য মৈথিলীর বড় প্রিয়। এখানে আসার আগে কলকাতায় মামার বাড়িতে তার সকাল হত কিছু শব্দের সমাহারে। ঘড়ির এ্যালার্মের কর্কশ আওয়াজ, বাসনের ঝনঝনানি, মামীর তীক্ষ্ণ গলার চীকার, কাজের লোকেদের ঝগড়া.... এসবের মাঝে কোনোদিন ভোরের রূপ দেখার সুযোগ হয়নি মৈথিলীর।

সাহেবগঞ্জে সকাল আসে লাজুক অষ্টাদশীর ন্যায়, সোনালী ঘাঘড়া পরে... দূরের পাহাড়শ্রেণীর গা বেয়ে.... শালের বন ছুঁয়ে... একাধিক স্বচ্ছতোয়ার আরশিতে  নিজের সাথে চোখাচোখির পর সুন্দরী সকাল লুটিয়ে পড়ে বাবামশাইয়ের বাগানের ঘাসের মখমলে।

মহুয়ার গন্ধে ভারি হয়ে ওঠা বাতাস এসে মিতালী পাতায় মৈথিলীর সাথে। তিতির পাখির ঝাঁক, শালিক দম্পতি আড্ডা জমায় কখনো পেয়ারা গাছের ডালে, আবার কখনও বা আম গাছের পাতার ফাঁকে। জংলি ফুলের লালচে আভার সাথে রঙমিলন্তি খেলে সোনালী সকাল। প্রকৃতির রঙের ছোঁয়া মৈথিলীর  জীবনেও ।বাবামশাইয়ের জোড়াজুড়িতে শুভ্রবসন ত্যাগ করে মৈথিলী, অঙ্গে আবার তার প্রিয় লালকে ধারণ করেছে।

বাবা বাবামশাই..... এই মানুষটি তার জীবনের দিকনির্দেশক... অবিচল, স্থির... ধ্রুবতারা যেন। নিজের গভীর, গোপন যা কিছু, সব... সব তিনি মৈথিলীর কাছে প্রকাশ করেছেন। অতীতের আঁধার কাটিয়ে আলোয় ফেরা মানুষটি মৈথিলীকেও টেনে এনেছেন সেই আলোকবৃত্তে।

কলকাতার নামকরা ডাক্তার রজতশুভ্র ব্যানার্জী..তার নাম, যশে ঈর্ষান্বিত, তার সহকর্মীদের চক্রান্তে  সবার চোখে বিনা দোষে এক রোগিনীর মৃত্যুর জন্য দায়ী হয়েছিলেন। ঘটনার সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করেনি তার কাছের মানুষেরা...সমাজ, সংসারের চোখে তিনি সেদিন কেবলমাত্র একজন খুনি হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছিলেন।

কেউ তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। তার এতদিনের সেবাকর্ম, তার অর্জিত সম্মান এক নিমেষে ধূলায় মিশে গিয়েছিল। ভগ্নমনোরথে, অপমানিত, মানষিক যন্ত্রনা তাড়িত  মানুষটি নিজের কালিমা লিপ্ত বর্তমানকে বিসর্জন দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন।

সাহেবগঞ্জের প্রকৃতি, এখানকার সহজ, সরল মানুষ গুলোর মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন আশ্রয়। এদের আপন করে নিয়েছিলেন...  এদের মাঝেই বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজের সবটুকু জ্ঞান। পরবর্তীতে কলঙ্ক মুক্ত হয়েছিলেন বটে... কিন্তু আর ফিরে যাননি ইট, কাঠ, পাথরের শহরে, মেকি মনুষ্যত্বের মাঝে।

সাহেবগঞ্জের আদিবাসী, নিরক্ষর, সহজ মানুষগুলোর ভালোবাসায়, তাদের নির্ভরতায় মাখামাখি বাবামশাইয়ের বর্তমান তার অতীতের সমস্ত মিথ্যা অপবাদ, কাছের মানুষের অসহযোগিতা, আত্মীয়, বন্ধু দের উপেক্ষার ক্ষতে প্রলেপ লেপে দিয়েছিল।

বাবামশাই মৈথিলীকে বলেছিলেন....  সাহেবগঞ্জের কুয়াশা মাখা শীতের সকাল..পাহাড় শ্রেণীর রোয়াওঠা সবুজ...বাতাসে ভাসমান মহুয়ার মিষ্টি সুবাস...শাল বনের হলদে সাদা মিশ্রিত ফুল..গর্ভবতী জোস্না রাত... দ্রীম দ্রীম রবে দূর থেকে ভেসে আসা মাদলের বোল তার টলমল আত্মবিশ্বাস, তার মৃত্যু কামী মন কে পরম মমতায় আশ্রয় দিয়ে ছিল। যে মানুষ গুলো বিপদে আপদে ভগবান কে স্মরণ করার পূর্বে তাদের বাবামশাই কে স্মরণ করে... তাদের এই বিশ্বাস ভার বহন করার জন্য তিনি আমৃত্যু এদের একজন হয়ে থাকবেন।

মৈথিলী উপলব্ধি করেছে.... একটি দুঃখী মেয়ে, একজন প্রতারিত মানুষ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে একে অপরের মাঝে...পিতা পুত্রীর নিবিড় বন্ধনে বাঁধা পড়েছে তারা প্রকৃতির উদারতার সাহচর্যে।এ আশ্রয় ভরসার...  এ আশ্রয় নিঃস্বার্থতার....  এ আশ্রয় আত্মসম্মানবোধের। তমসাছন্ন অতীত মুছে গিয়ে তাদের বর্তমান মিলিত হয়েছে একবিন্দু তে। জীবনে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে আশার আলো।

 

পৃথা সিনহা দাস



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top