সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১


নৌযাত্রা: আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ


প্রকাশিত:
৪ এপ্রিল ২০১৯ ১৩:০৮

আপডেট:
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৭:৪৩

নৌযাত্রা

গল্পটা আমার বন্ধু জিহাদের এক খালুকে নিয়ে। খালু ছোট খাটো ব্যাবসা করেন। ব্যাবসার প্রয়োজনে তাকে মাঝে মধ্যে ঝালকাঠি থেকে ঢাকা আসতে হয়। খালু সব সময় লঞ্চেই যাতায়াত করেন। খালু একটু বেশি পরিমানে কৃপণ। তাই লঞ্চের ডেকই তার প্রথম পছন্দ। ঝালকাঠি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে আসা লঞ্চগুলোর প্রায় সবই সন্ধ্যার দিকে যাত্রা শুরু করে। ঢাকায় এসে পৌছায় সকালে। খালু ডেকের উপরে একটা চাদর বিছিয়ে এক ঘুমে রাত কাবার করে দেন। সতর্কতা হিসাবে এটা রশির এক প্রান্ত দিয়ে তার ব্যাগটাকে বেঁধে রাখেন আর অন্য প্রান্ত দিয়ে বেঁধে রাখেন নিজের ডান হাতটাকে এত সতর্কতার পরেও প্রতি বারই কোন না কোন অঘটন ঘটে।

প্রতিবারের মত এবারও খালু ঝালকাঠি থেকে যাত্রা শুরু করেছেন। এবার খালু পণ করেছেন কোন অঘটনই তিনি ঘটতে দিবেন না। অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য তিনি রাতে কম ঘুমালেন। কাক ডাকা ভোরে লঞ্চ এসে সদরঘাটে ভিড়লো। লঞ্চ থেকে নেমে খালু একটা বিজয়ের হাসি দিলেন। টারমিনাল থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে খালু একটা রিক্সা নিলেন। গন্তব্য বকশি বাজার। খালু রিক্সায় মাত্র এক পা দিয়েছেন এমন সময় বিশ বাইশ বছরের একটি ছেলে এসে বলল, “চাচা আমিও বকশি বাজারে যাব, চলেন এক সাথে শেয়ারে যাই।” শেয়ারে যাবার কথা শুনে খালুর কৃপণতা স্বভাবটা চাঙ্গা হয়ে উঠলো। খালু রাজি হয়ে গেলেন। খালুর একটা বিশেষ গুন হচ্ছে তিনি খুব আলাপ প্রিয় মানুষ। রিক্সা চলছে আর খালুর সাথে এই ছেলেটির আলাপও বেশ জমে উঠেছে। খালুর বাড়ি ঝালকাঠি এ কথা শুনে ছেলেটা বলে উঠলো “আরে চাচা, আপনার বাড়ি ঝালকাঠি এ কথা আপনি আগে বলবেন না। আমার আপন ছোট চাচাওতো থাকেন ঝালকাঠি। ব্যাংকে চাকরী করেন”। মাথাটা ইষৎ সরিয়ে ছেলেটার দিকে ভাল করে তাকিয়ে খালু বললেন “খারাও খারাও তোমারে দেইক্কাই আমার সন্দেহ হইছেলো। রহমান সাইবে তোমার চাচা নাকি?”

“আপনার ক্ষমতা দেখেতো আমি একেবারে তাজ্জব হয়ে গেলাম। আপনি ঠিকই ধরেছেন রহমান সাহেবই আমার চাচা”। এরপর ঐ ছেলেটা খালুর এই বিশেষ ক্ষমতার প্রশংসার পঞ্চমুখ হয়ে গেল। খালুও তার জীবনের বিভিন্ন উদাহরন টেনে এনে ছেলেটাকে বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি আসলেই এই বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। আলাপ জমলো বেশ। একটা পর্যায়ে ছেলেটা বলল, “চাচা, কিছু মনে না করলে আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম, বিষয়টা হচ্ছে গিয়ে আমি এবার বি.এ পাশ করেছি। খবরটা আমার চাচা, মানে রহমান সাহেব, জানেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে আমি মিষ্টি পাঠাতে পারলাম না। আমি আপনাকে দুইশত টাকা দিতে চাচ্ছিলাম। আপনি যদি আমার হয়ে চাচাকে মিষ্টি কিনে দিতেন--”

“এইডা কোনো বিষয় হইলো। তুমি টাকা দেও দেহি। মিষ্টি কিইন্না আমি নিজেই রহমান সাইবের বাসায় যাইয়া দিয়া আসমু।” ছেলেটা হেসে দিয়ে বলল, ” চাচা আমার কাছে তো পাঁচশত টাকার নোট, আপনার কাছে ভাংতি থাকলে দুই’শ টাকা রেখে আমাকে তিন’শ টাকা দেন।” ছেলেটা একটা পাঁচশত টাকার নোট এগিয়ে দিলেন খালুর দিকে। খালু কোমড়ে হাত দিয়ে লুঙ্গির ভাঁজের মধ্যে লুকানো টাকার থলেটা বের করলেন। এই পর্যায়ে রিক্সাচালক বেশ কষে ব্রেক করল। বড় একটা ঝাকুনিতে খালু উল্টি খেয়ে গড়িয়ে পড়লেন রাস্তায়। আশপাশ থেকে লোকজন এসে খালুকে ধরাধরি করে একটা দোকানে নিয়ে বসালো। খালুর চারিদিকে অনেক লোক জমে গেছে। সে সব লোকের মাঝে খালু রহমান সাহেবের ভাতিজাকে খুঁজছেন। কিন্তু তাকে আর কোথাও পাওয়া গেলে না। রিক্সা চালকও লা-পাত্তা। টাকার থলেটাও হাওয়া।

এবার খালুর ফেরার পালা। ঢাকায় আসার সময় এত বড় একটা বিপদ ঘটেছে দেখে খালু এবার আরো অনেক বেশি সর্তক। ঢাকায় এসে খালু তার এক ভায়রার বাসায় ওঠেন সব সময়। সেই ভায়রা সদর ঘাটে এসে খালুকে উঠিয়ে দিয়ে গেছেন লঞ্চে। খালু একটা সিঙ্গেল কেবিন নিতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু দেখা গেল একটা ডাবল কেবিনের এক সিট খালি আছে। সেটা নিলে একশত টাকা বেঁচে যায়। একশত টাকা বাঁচানোর পক্ষেই খালু প্রায় মত দিয়ে ফেলেছিলেন। হঠাৎ খালুর ভয় হলো - কেবিনের অন্য লোকটা যদি প্রতারক হয়? ঘুমের ঔষধ খাইয়ে যদি সর্বস্ব লুটে নেয়? কিন্তু একশত টাকা বেঁচে যাবার কাছে এই চিন্তা দীর্ঘ স্থায়ী হলো না। খালু ডাবল কেবিনের এক সিটই নিলেন। খালু নিজেকে অভয় দিলেন - কোন প্রতারক কি পয়সা খরচ করে কেবিনে যাতায়াত করে? তাছাড়া লোকটার গন্তব্যও ঝালকাঠি। আলাপ আলোচনায় কোনো পরিচয়ও নিশ্চই বের হয়ে আসবে।

লোকটা কে দেখার পর খালুর মনে যতটুকু ভয় ছিলো তা দূর হয়ে গেল। নিতান্তই ভদ্র একটা লোক। এই লোকটা সম্বন্ধে এতক্ষন কত উল্টা পাল্টা চিন্তাই না করা হয়েছে এটা ভেবে খালুর একটু লজ্জ্বাও লাগছে।

ইতিমধ্যে মাগরিবের নামাজের সময় হয়েছে দেখে খালু রুমের মধ্যে তার লাগেজ রেখে নামাজ পড়তে গেলেন। লঞ্চের মধ্যেই জামাতে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে। যাবার আগে খালু একটা কাজ করলেন চতুরতার সাথে। তিনি লাগেজের তালার চারপাশে চুন মাখিয়ে দিলেন। যাতে কেউ তালা ধরলেই বুঝতে পারা যায়। নামাজ শেষ করে এসে খালু আবার পরীক্ষা করে দেখলেন - সব কিছুই ঠিক আছে।

ঝালকাঠির লঞ্চ গুলো সদর ঘাট থেকে সন্ধ্যার একটু পরে ছেড়ে দেয়। ঝালকাঠি গিয়ে পৌছায় সকাল বেলা। খালুদের লঞ্চ ছাড়লো সন্ধ্যা সাতটার সময়। খালুর সাথে ঐ লোকটার আলাপ বেশ ভালই জমে উঠেছে। খালু কৌশলে লোকটার সমস্ত খবরাখবর নিয়ে নিলেন - লোকটা তার নাম বলেছে জাকির হোসেন, একটা এন.জি.ও র বড় কর্মকর্তা। সেই এন.জি. ও র অডিটের কাজেই নাকি ঝালকাঠি যাচ্ছেন।

রাত আটটার দিকে খালু এশার নামাজ পড়তে গেলেন। যাবার আগে জাকির হোসেনকে বললেন তার সাথে রাতে খাওয়ার জন্য “হোনেন, আমনে কিন্তু রাইতে আমার লগে খাইবেন, আমি বাসা দিয়ে অনেক খাবার লইয়া আইছি। দুই জনের ভালই হইয়া যাইবে।”

“আমিও অল্প কিছু খাবার নিয়ে এসেছি। রাতে আমি আবার একটু কম খাই। ঠিক আছে আপনি যখন বলছেন একসাথেই খাবো। আপনি আগে নামাজ পড়ে আসুন।”

খালু নামাজ পড়ে ফিরে এলেন প্রায় আধা ঘন্টা পরে। কেবিনে ঢুকতে যাবেন এমন সময় কেবিনের কাঁচের জানালা দিয়ে দেখলেন জাকির হোসেন খালুর টিফিন কেরিয়ার খুলে কি যেন করছে। খালু ভবলেন জাকির হোসেন যেহেতু অল্প খাবার এনেছে তাই সে দেখছে খালু কি কি এনেছেন। কিন্তু এই দৃশ্য খালু দেখে ফেলেছেন এটা যদি জাকির হোসেন দেখে তাহলে তো জাকির হোসেন অনেক লজ্জা পাবে। তই খালু একটু উল্টো ঘুরে দাড়ালেন যাতে জাকির হোসেন নির্বিঘেœ তার কাজ সম্পন্ন করতে পারে।

জাকির হোসেন নির্বিঘেœই তার কাজ শেষ করলো। খালু গলা খেঁকে দরজায় কড়া নাড়লেন। জাকির হোসেন দরজা খুলে দিলে কেবিনে ঢুকে খালু বললেন “আসেন আমরা খাইয়া লই। এশার নামাজের পরপরই আমার খাওনের অইভ্যাস”

জাকির হোসেন হেসে দিয়ে বলল, “আমার একটু রাত করে খাওয়ার অভ্যাস । কোন অসুবিধা নেই, আপনি খেয়ে ফেলুন। আমি পরে খেয়ে নিবো”।

জাকির হোসেনের জন্য খাবার রেখে খালু খেয়ে নিলেন এবং জাকির হোসেনকে দেখিয়ে দিলেন টিফিন কেরিয়ারের কোন বাটিতে কি আছে। এরপর খালু বিছানায় শুয়ে দিলেন এক ঘুম।

সকালে লঞ্চ এসে থামলো ঝালকাঠি । যাত্রীরা সবাই নেমে যাবার পর কেবিন বয় এক একটা করে কেবিন চেক করছে। খালুর কেবিনের সামনে এসে দেখলো দরজা খোলা আর খালু অচেতন হয়ে ঘুমাচ্ছেন। কিছুক্ষন চেষ্টা করে খালুকে সজাগ করাতে না পেরে সে লঞ্চের অন্য লোকজনদের ডেকে নিয়ে আসলো, সবাই মিলে অনেক চেষ্টার পর, প্রায় আধা ঘন্টা পরে খালুর জ্ঞান ফিরলো। খালুর সহযাত্রী, মানে জাকির হোসেন, অনেক আগেই খালুর ব্যাগ আর টাকা পয়সা নিয়ে উধাও হয়েছে। খালুর সাথে আছে শুধু ঐ টিফিন কেরিয়ার।

জ্ঞান ফিরলেও খালু তার স্মৃতি পুরোপুরি ফিরে পাননি। গত রাতের ঘটনা তিনি কিছুই মনে করতে পারছেন না। তবে কোন্ গ্রামে তার বাড়ি এটা তিনি ঠিক মত বলতে পেরেছেন। নদী পাড় হয়ে ত্রিশ চলি¬শ মিনিট নৌকা চালানোর পরে খালুদের গ্রামে পৌঁছানো যায়। একজন মাঝিও পাওয়া গেল পাশের গ্রামের। মাঝি খালুকে খুব ভাল ভাবেই চিনে। সবাই মিলে খালুকে ধরাধরি করে নৌকায় উঠিয়ে দিলো। খালুর সাথে লাগেজ বলতে শুধু ঐ টিফিন কেরিয়ার। মাঝি খালুকে বলল যে সে সকাল থেকে কিছুই খায় নাই এক ডুবে গোছল শেষ করে চারটা ভাত খেয়েই নৌকা ছেড়ে দিবে। মাঝি গোছল শেষ করে গামছা দিয়ে বাঁধা তার ভাতের পোটলা খুলতে যাবে এমন সময় খালু বলল “তুমি একটা কাম করো। তোমার ভাত থুইয়া দেও। ঐডা দুফারে খাইয়ো। এই টিফিন কারিতে ভাত মাছ ডাইল আছে, এই ডা খাইয়া লও।”

দরিদ্র মাঝি ফ্রি পেয়েছে। খাবেই তো । তৃপ্তি সহকারে খেয়ে বৈঠা হাতে নিয়ে বসা মাত্রই মাঝির মনে হল তার সমস্ত শরীর অসার হয়ে আসছে। চোখ তুলে সে একবার খালুর দিকে তাকাতেই ঝুপ করে পড়ে গেল নদীর মধ্যে। আশপাশ থেকে অন্য মাঝিরা ঝাপিয়ে পড়ে তাকে প্রাণে রক্ষা করলো। আর খালুর কথা কি আর বলব পুরোপুরি স্মৃতি ফিরে পেতে তার সময় লেগেছিল আরো পাঁচ দিন।       



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top