দর্পনে ভালবাসা


প্রকাশিত:
৪ এপ্রিল ২০১৯ ১৪:২২

আপডেট:
৪ এপ্রিল ২০২০ ১৮:৪২

তানজীম কোরেশী

তানজীম কোরেশী (উদিতা), ওয়াকলাহোমা, আমেরিকা: ভালবাসার সংজ্ঞা,স্বরূপ বা প্রকাশ ভংগি সবসময় বেশ জটিল লাগে।স্কুলজীবনে প্রতিদিন সকালে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় মনে হত দেশের জন্যই মনে হয় আমার ভালবাসা, আবার আব্বা যখন দরদি গলায় নিখাদ আবেগ নিয়ে ‘মা’ বলে ডাকতেন ,তখন মনে হতো আব্বাকে জুড়েই আমার ভালবাসা।

কখনো আবার ভালো রেজাল্ট হাতে ঘরে ফিরলে আম্মা যখন একস্স্ট্রা কেয়ার করতো ,ভালবাসাটা তখন সবকিছু উপচে আম্মার দিকে নুয়ে পরতো।দাদা-দাদী,নানা-নানী,মামা,চাচা,খালা,ফুফুদের কথা না হয় বাদ দিলাম।বয়সন্ধির সময়টাতে উড় চিঠি গুলো যখন পাঠ্যবই গুলো কে দুরে সরিয়ে দিত ,তখন মনে হত ‘আরে এতদিন কি অবুঝ ছিলাম আমি !ভালবাসা আসলে ঐ চিঠির লেখকের জন্য।’

সেসময় কবিতা,উপন্যাস ,রোমান্টিক গান ,ফুল,পাখি ,প্রকৃতি সবকিছুই ভালবাসতে ভাল লাগত। এই ভালবাসায় জড়াজড়ি করা রোমান্টিক হৃদয় নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো অচেনা ,অজানা, লোকের সাথে।আমার ভালবাসায় পরিপূর্ন হৃদয় বিয়ের পরপরেই চোট খেলো.....বিয়ের পর হানিমুনে যেতে হবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু হায় হায় ! বলে কি লোকটা !!”হানিমুনে যাবার দরকার কি?দুজনেত বাকী জীবন একসাথে একাই থাকবো আমাদের সংসারে ,সারাজীবনই আমাদের হানিমুন ,বরং যে কটা দিন দেশে আছি আত্মীয় স্বজনদের সাথে সময় পার করি।”

এত বেরসিক লোকটার সাথে জীবন কেমন করে কাটাবো? বিয়ে হয়েছে বলে ভালবাসাহীন দাম্পত্যজীবন কাটাতে হবে ......এ মেনে নেয়া কি আমার পক্ষে সম্ভব?কিন্তু আমি টেরই পেলাম না বাস্তবতাকে ভালবাসা এই অচেনা লোকটা আমাকে কিভাবে , কখন ভালবেসে ফেললো.....আমি নিজেও কখন যে তাকে ভালবাসতে শুরু করলাম সেটাও আজো অজানা।তবে স্পষ্ট মনে আছে কবে থেকে তার প্রতি আমার ভালবাসাটা বাড়তে থাকলো ,মানে গভীর থেকে গভীরতম হলো।এই প্রথম অনুভব করলাম যে,ভালবাসা আসলে একটা অনুভুতি, প্রকাশে তার স্থায়িত্ব বাড়ে।

নতুন বাসা কিনেছি ,ঘর সাজাচ্ছি স্বপ্নের মত করে।বাজেট ধরে ,সেল দেখে , সময় নিয়ে ঘর সাজানোর জিনিস কিনছি।অনেক খুঁজে খুঁজে একটা কারুকাজ করা গোল ফ্রেমের বড় একটা আয়না কিনলাম। দেয়ালে টাংগানোর অল্প সময়ের মধ্যেই আয়নাটা পরে ফ্রেমটা চুরমার হয়ে গেল ,শত খন্ডে ........কিন্তু আয়নাতে ক্ষতের কোন আঁচড় লাগলো না।ভীষণ কষ্টে আমার কান্না পেল।এত পছন্দের জিনিসটা কারণ ছাড়াই নষ্ট হলো......না জানি সামনে কি বিপদ অপেক্ষা করছে? আসন্ন বিপদের মিছে আশংকায় আমি অবুঝ বাচ্চার মত হাউমাউ করে কাঁদলাম।

আমার স্বামী আয়নাটি সরিয়ে খন্ড বিখন্ডিত ফ্রেমটা তুলে নিয়ে সযত্নে তার স্টাডি রুমের মেঝেতে রেখে দরজা বন্ধ করে বললো, ‘ এ ঘরটাতে বাচ্চাদের ঢুকতে দিও না,আমি তোমার আয়নাটা ফিক্স করে দেবো।’ আমি রাগে দুক্খে কিড়মিড় করে বললাম,’তামাশা করো না ,এইটা জীবনেও ফিক্স করা যাবেনা,শুধু শুধু আবর্জনা জমিয়ে ঘর বন্ধ করে রেখো না।’ আমার বর বললো, ‘ শাহজাহান যদি ভালবেসে তাজমহল গড়তে পারে তাহলে আমি ভালবেসে একটা ফ্রেম ফিক্স করতে পারবো না?’

আমার সেই ভাংগা ফ্রেমটা মাস ছয়েক পরে রইল স্টাডি রুমের মেঝেতে।এর মাঝে আমার বর কাজ থেক ঘরে ফিরে প্রতি রাতে কিছু সময় ব্যয় করে ফ্রেমটার পিছে।আমি ভুলেও উকিঁ দিয়ে তাকাই না রুমটাতে ,জানি শেষ পর্যন্ত সেটা আমারই ক্লিন করতে হবে।একদিন বাচ্চাদের নিয়ে স্কুল থেকে ঘরে ফিরে দেখি আমার বর ড্রিল দিয়ে দেয়ালে স্ক্রু লাগাচ্ছে ।জ্ঞিজ্ঞেস করলাম ,”কি করছো তুমি?” সে উত্তর দিল,’ আমার ভালবাসার তাজমহল টাংগাবো ,একটু সাহায্য করো।’ গাড়ীর চাবিটা জায়গায় রেখে ফিরে আসতেই চোখে পরলো আমার সেই আয়নাটা ........অবিকল আগেরই মত , কেবল কিছু এ্যান্টিক টাচ আপের পরশ যোগ হয়েছে, যা কিনা ফ্রেমটাকে আরো বেশী আকর্ষনীয় করেছে।আনন্দে আরেকবার কাঁদলাম।

১৬ বছর ধরে আমি অবাক বিস্ময়ে আয়নাটার দিকে প্রতিদিন তাকাই আর ভালবাসার সংজ্ঞা,স্বরূপ খুঁজি।আজ ভালবাসা আমার কাছে একটা দর্পন ,যেখানে তাকালে ভালবাসার মানুষটার প্রতিবিম্ব দেখতে পাই , আর ভালবাসার মানুষটা একটা প্রিজম ,যে কিনা আলো ছড়িয়ে আমার ভালবাসায় অন্ধকার নামলে তাকে জ্যোতিময় করে।আসলে ভালবাসা মনে হয় একটা বৃত্ত ,যা কিনা ঘুরে ফিরে একটা বলয়ে আটকে থাকতে চায়।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top