সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


প্রবাসীরা কেন বাংলাদেশী রাজনীতি করেন: সাইফুল আলম তালুকদার


প্রকাশিত:
১ এপ্রিল ২০২০ ০৬:১৮

আপডেট:
১ এপ্রিল ২০২০ ২২:৩৮

সাইফুল আলম তালুকদার

 

বাংলাদেশের যেসব মানুষ বিদেশে বসবাস করে তাদের প্রবাসী বলা হয়। প্রবাসী দুই ধরনের। একশ্রেণীর প্রবাসী বিদেশী নাগরিকত্ব অর্জনের মাধ্যমে বিদেশে বসবাস করছেন। আরেক শ্রেণীর প্রবাসী জীবিকা নির্বাহের তাগিদে অস্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করছেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী প্রবাসীদের মধ্যে শেষোক্ত শ্রেণীর প্রবাসীর সংখ্যাই বেশি। ধারণা করা হয়, বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উভয় শ্রেণীর প্রবাসীর সংখ্যা ৮০ লাখ অতিক্রম করে গেছে। সংখ্যাটি বাংলাদেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার ৫ শতাংশের ঊর্ধ্বে। বর্তমানে বাংলাদেশের এমন কিছু প্রবাসী যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন, যাদের প্রজন্ম দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অবধি বিস্তৃত হয়েছে।

সাধারণত দেখা যায়, কোনো দেশে অবস্থানরত দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রবাসীরা চালচলন ও কথাবার্তায় সম্পূর্ণরূপে নিজেদের ওইসব দেশের উপযোগী করে তোলে। কিন্তু বাঙালিদের ক্ষেত্রে নাড়ির টান অধিক হওয়ায় দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের প্রবাসীরা যতই নিজেদের ভিনদেশী কৃষ্টি ও সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করুক না কেন, তারা নিজ দেশের পূর্বপুরুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রেও সচেষ্ট।

এদিক থেকে আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের একই শ্রেণীর প্রবাসীদের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা প্রবাসী হিসেবে যে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে, নিজেদের সম্পূর্ণরূপে সে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলেছেন। এ ধরনের ভারতীয় প্রবাসীরা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কী ঘটছে তা নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত নন। এমনকি ভারতের যেসব প্রবাসী অস্থায়ীভাবে জীবিকার উদ্দেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন, তারাও যে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিষয়ে খুব বেশি তৎপর— এমনটি পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশের উভয় শ্রেণীর প্রবাসীদের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন এর মন্তব্য : - প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীরা যেভাবে রাজনীতি করছেন, এক কথায় তা হতাশাজনক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো অন্য কোনো দেশের রাজনৈতিক দল এভাবে প্রবাসে রাজনীতি করে না। বাংলাদেশ থেকেও বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশ রয়েছে। ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রাজনৈতিক দল এভাবে রাজনীতি করছে না।

লেবার পার্টি কিংবা কনজারভেটিভ পার্টির কোনো শাখা বাংলাদেশে নেই। স্বাধীনতা অর্জনের পরও বাংলাদেশে এ অবস্থা ছিল না, যা ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রকট হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের সময়ে প্রয়োজনের কারণে শুধু আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রবাসে ছিল। দেশ স্বাধীন করার জন্য সেটা জরুরি ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রবাসে রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা স্থায়ীভাবে প্রবাসে বসবাস করেন। সেক্ষেত্রে তাদের উচিত ওই দেশের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়া। ভারতীয় ও আফ্রিকানরা সেটিই করছেন। অনেকেই সেখানকার পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। যে কোনো কারণেই হোক, বাংলাদেশের উভয় শ্রেণীর প্রবাসী নিজ দেশের রাজনীতি বিষয়ে খুব বেশি সচেতন।

পৃথিবীর যেসব দেশে ও শহরে বাংলাদেশী প্রবাসীর সংখ্যা সহস্র অতিক্রম করেছে, সেসব দেশ ও শহরে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির সংগঠন রয়েছে। যেসব দেশ ও শহরে প্রবাসে বাংলাদেশীর সংখ্যা কয়েক সহস্র বা লক্ষ অতিক্রম করেছে, সেসব দেশ বা শহরে দেখা যায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দুটি দলের একাধিক কমিটির অস্তিত্ব বিদ্যমান। মূলত নেতৃত্ব ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল— এ দুটি কারণেই একাধিক কমিটির আবির্ভাব।

আমাদের দেশ থেকে বড় দুটি দলের নেতৃস্থানীয়রা যখন বিদেশ সফরে যান তখন উভয় দলের বিদেশের সংগঠন তাদেরকে উপলক্ষ করে সভা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আর যখন দুটি দলের প্রধানের আগমন ঘটে তখন দেখা যায় বিমানবন্দরে তাদের আগমন ও প্রস্থানের সময় বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি। তাছাড়া বিদেশে তারা যে হোটেলে অবস্থান করেন, সেখানকার লবিতে দেখা যায় সার্বক্ষণিক নেতাকর্মীর সরব উপস্থিতি।

আমাদের বড় দুটি দলের নেত্রীদ্বয়ের তিনবার করে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ ঘটেছে। এ দুটি দলের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখনই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরে গেছেন দেখা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতাকর্মীরা কালো পতাকাসহকারে বিমানবন্দর ও তাদের সম্ভাব্য আলোচনার স্থানগুলোয় উপস্থিত হয়ে আপত্তিকর স্লোগানের মাধ্যমে আগমনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিদেশীদের সামনে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন। এ ধরনের একাধিক ঘটনায় উভয় দলের নেতাকর্মীর মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির উপক্রম হলে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে।

দেশের বাইরে কি রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা খোলার কোনো আইন আছে? সেটা যেন রাজনৈতিক দলগুলো করতে না পারে, এ দায়িত্ব সংসদের। সংসদে ক্ষমতাসীন দল তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এ আইন প্রণয়ন করতে পারে। আরো মজার বিষয় হলো, এ বিষয়ে উভয় দল একমত। বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশে থাকা প্রবাসী রাজনৈতিক শাখা বন্ধ করতে চায় না। আমরা যখন বলেছি, বিদেশে রাজনৈতিক শাখা খোলা যাবে না, তখন তারা সে দেশে আলাদাভাবে রেজিস্ট্রেশন করে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চেয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব দলীয়ভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, প্রবাসী রাজনীতি কোনোভাবেই তাদের উপকারে আসছে না। তা-ই যদি আসত, তাহলে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল কংগ্রেস বিশ্বব্যাপী তাদের শাখা খুলত। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের প্রতি পাঁচজন লোকের একজন ভারতীয়। সেক্ষেত্রে তারা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু তারা সেটি করছে না।

রাজনৈতিকভাবে কোনো উপকার না হলেও ফান্ড তো আসছে। সেখানে তাদের অনেক বড় লভ্যাংশ আছে। প্রচুর আয় হচ্ছে। এছাড়া অনেক নেতাই সেখানে গিয়ে দিনের পর দিন থাকছেন, তাদের ভরণ-পোষণের তো একটা ব্যাপার আছে! বড় বড় নেতা সে সুযোগ নিচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। এ সুযোগ বিভিন্ন স্তরের ক্ষুদ্র নেতারাও নিচ্ছেন। প্রবাসে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে যেসব বাংলাদেশী বসবাস করছেন, তারা কেন নিজ দেশ থেকে সুদূর বিদেশে অবস্থানের পরও নিজেদেরকে স্বদেশের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখছেন, এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অবলম্বন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার মানসে তাদের এ প্রয়াস। তাছাড়া ক্ষমতাসীন দলের নেতৃস্থানীয়দের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এসব প্রবাসী যখন দেশে আসেন, তখন স্থানীয়রা এদের যোগাযোগের পরিধি দেখে এদেরকে অনেকটা সমীহ করে চলে।

স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাসরত যেসব বাংলাদেশী ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় দেশে সরকারি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দেশ ও বিদেশ উভয় স্থানে ব্যবসার উৎকর্ষ সাধনে সহায়ক। দেশ ও বিদেশে প্রবাসীদের অবদান ম্লান হয়ে যায় তখনই, যখন দেখা যায় এরা নিজ দেশের সরকারি ও বিরোধী দলের নেতৃস্থানীয়দের বিদেশে সম্মান জানানোর পরিবর্তে কালো পতাকা প্রদর্শন, আপত্তিকর স্লোগান দিয়ে অসম্মান ও অশ্রদ্ধা করছেন। এ ধরনের অসম্মান ও অশ্রদ্ধা তাদের ও দেশের মর্যাদার জন্য হানিকর। তাই আর যাহোক, স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বসবাসরত প্রবাসীদের রাজনৈতিক ভাবনা যেন সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির আবদ্ধতায় দেশের মর্যাদার হানি না ঘটায়— এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top