সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

সিডনি ভ্রমণের স্মৃতি (তৃতীয় পর্ব) : আনিসুল কবীর


প্রকাশিত:
২৮ এপ্রিল ২০২০ ০৩:১৩

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৩০

আনিসুল কবীর

 

২০১৭ সালের এপ্রিলের শেষে মাত্র ৩ দিনের জন্য সিডনি ভ্রমণ নিয়ে ৩ পর্বের ভ্রমণ স্মৃতির এটা তৃতীয় ও শেষ পর্ব। মাত্র তিন দিনের স্মৃতি হলেও সিডনির ঘুরাঘুরির স্মৃতি অনেকদিন মনে থাকার মতো ছিলো। আগের পর্ব গুলোতে আামি সিডনী শহরের গুরুত্বপূর্ন কিছু জায়গা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবং সিডনী শহরের মধ্যে যেসব সমুদ্রসৈকত আছে সেইসব জায়গাগুলো সম্পর্কে লিখেছি। আজকে তৃতীয় পর্বটিতে তুলে ধরবো সিডনীর আরেকটি আকর্ষনীয় ভ্রমণআকর্ষণ ব্লু-মাউন্টেন ((Blue Mountain) ) সম্পর্কে। যদিও আমি ব্লু মাউন্টেন জায়গাটি খুব ভালো করে ঘুরে দেখতে পারি নাই, কিন্তু তারপরেও জায়গাটির প্রাকৃতিক বৈচিত্র আমাকে মূগ্ধ করেছিলো ভীষণ।
আগেই বলেছি আমি সিডনী শহরে রতন ভাইয়ের বাসায় উঠেছিলাম। রতন ভাই আমার বড় ভাই বাবু ভাইয়ের বন্ধু। রতন ভাইয়ের সাথেই ঘুরেছি বলে খুব সহজে মাত্র আড়াই দিনে সিডনীর অনেক জায়গাতেই ঘুরতে পেরেছি। শেষ দিনে ঘুরেছি ব্লু মাউন্টেন নামের পাহাড়ী এলাকার একাংশ। এই ৩ পর্বের লেখায় আমি বারবার বলেছি এটা ছিলো ৩ দিনের ভ্রমণ, কিন্তু আদতে আমি সিডনী ভ্রমণে পুরো ৩ দিন হাতে পাইনি। শেষ দিনে মাত্র মধ্যাহ্ন পর্যন্ত সময় পেয়েছি ঘুরাঘুরির জন্য। দুপুরের পরে মেলবোর্ণের ফ্লাইট থাকাতে মাত্র ২ ঘন্টার জন্য ব্লু মাউন্টেন এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। তারপর সোজা এয়ারপোর্ট। আমার মনে হয় ব্লু মাউন্টেনের বিখ্যাত থ্রি সিস্টারস্ বা তিন বোন নামের পাহাড়ের সামনে ছবি না থাকলে সিডনী ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আর আমি চাইনি যে আমার সিডনী ভ্রমণ এলবামটি অসম্পূর্ণ থেকে যাক।
আমরা সিডনিতে প্রথম দিন দেখে বেড়িয়েছি সিডনির জগতবিখ্যাত সব ল্যান্ডমার্ক বা স্থাপনাসমূহ যেসবের জন্য সারা পৃথিবী সিডনি শহরকে চিনে। সিডনি অপেরা হাউস, সিডনি হারবার ব্রিজ আর সিডনির সেন্টারপয়েন্ট অবজারভেশন ডেক। দ্বিতীয় দিন ঘুরেছি সিডনীর সৈকতে সৈকতে। তৃতীয় দিন ছিলো শেষ দিন, তাই আগের রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম। শেষ দিন যেটুকু সময় পাবো পুরোটাই ব্লু মাউন্টেনের জন্য ব্যায় হবে।
সকাল সকাল রানাটা ভাবি অফিসে চলে যাওয়ার পরে আমি আর রতন ভাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেই। তাড়াতাড়ি বের হওয়ার ইচ্ছায় সকালের নাস্তাটা বাসায় না করেই বের হয়ে যাই। সিডনী থেকে ব্লু মাউন্টেনের প্রধান শহর কাটুম্বার (কধঃড়ড়সনধ) দুরত্ব প্রায় ২ ঘন্টার মতো। প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে সকাল ৮ টার পরে আমরা ব্লু মাউন্টেনের দিকে রওনা হই। অন্য ২ দিন কোয়েকার হিল থেকে মূল শহরের দিকে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু ব্লু মাউন্টেনের রাস্তা শহরের উল্টো দিকে। আমরাও উল্টো রাস্তায় চলা শুরু করি। সুন্দর রাস্তা, অনেক বেশি ফাঁকা আর প্রাকৃতিক। রাস্তাটি ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে থাকে তবে প্রচলিত হিল স্টেশনগুলোর মতো সোজা উপরের দিকে উঠতে হয় না। খুব ধীরে ধীরে সমুদ্র সমতল থেকে উপরের দিকে উঠতে থাকে রাস্তাটা। মনে মনে বেশ উত্তেজনা কাজ করছিলো, কারন ব্লু মাউন্টেনের প্রাকৃতিক বিন্যাস আমার খুব পছন্দের। টিভিতে অনেক দেখেছি। প্রায় ১০ লক্ষ হেক্টরের এই বিশাল পাহাড়ি অঞ্চলে বেশ কিছু শহর, নদী ও প্রাচীন ইউকেলিপটাস বন, জল প্রপাত, চুনা পাথরের খাড়া পাহাড়ের দেয়াল যেন সৌন্দর্য্য আর রহস্যের ডালি সাজিয়ে বসে আছে। ব্লু মাউন্টেনের সৌন্দর্য যে কতো মনোহর, এই লেখার সাথে দেয়া ছবি দেখে পাঠক একমত হবে বলে আমার ধারনা। ব্লু মাউন্টেনের দৃশ্যগুলোর দিকে দুর থেকে তাকালে কেমন যেন একটা নীলচে রঙে মোড়া দেখা যায়। সেজন্য জায়গাটার নাম ব্লু মাউন্টেন খুব যৌক্তিক। উপর থেকে নিচে তাকালে গভীর জঙ্গল দেখা যায়। পাহাড়ের দেয়াল দিয়ে বেশ কিছু জল প্রপাত ঝরে পড়ছে। যতদুর চোখ যায়, শুধু চেপ্টা পাহাড়ের বিস্তার।

রওনা দেয়ার পর আমরা ব্লু মাউন্টেনে পৌছে যাই এক ঘন্টার চেয়ে কিছু বেশি সময় পরে। কাটুম্বায় পৌছে মনে হলো বেশ ভীড় শুরু হয়ে গেছে। প্রথমেই আমরা তিন বোন পাহাড় বা থ্রি সিস্টারস্ পাহাড় দেখার জন্য ইকো পয়েন্ট লুক আউট বলে জায়গায় যাই, যেখান থেকে ব্লু মাউন্টেনের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা থ্রি সিস্টারস্ পাহাড় দেখা যায়, সাথে ব্লু মাউন্টেনের বিশাল অঞ্চলের অনেকটাই দেখা যায়। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য বেশ কিছু সময় ঘুরাঘুরি করতে হলো। টুরিস্ট বাসগুলো ভরে ভরে টুরিস্ট নামছে দেখতে পেলাম। সবার গন্তব্য ইকো পয়েন্টের দিকে। ব্লু মাউন্টের উচ্চতা ১১০০ মিটার বা ৩০০০ ফুটের অধিক, তাই প্রচন্ড ঠান্ডায় যেন কুঁকড়ে গেলাম কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু ইকো পয়েন্ট থেকে ব্লু মাউন্টেনের মূল আকর্ষণ থ্রি সিস্টারস্ পাহাড় তিনটা দেখে খুব ভালো লাগলো। আরও ভালো লাগলো পাহাড়ের অনেক নিচের রহস্যময় গাছগাছালির বন আর পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জল প্রপাতগুলো। বিশাল অঞ্চল নিয়ে বিছিয়ে থাকা জায়গাটির দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। মেঘের ছায়া পড়ে আছে জায়গায় জায়গায়।


তাই কোন জায়গায় হালকা, আর কোন জায়গায় গাঢ় সবুজ দেখাছিলো। ইকো পয়েন্টে দাড়িয়ে কিছু ছবি তুলে নেই আমরা। যদিও ব্লু মাউন্টেন ভালো করে দেখার জন্য হাতে খুব বেশি সময় ছিলো না, তারপরও একদম কিছু না দেখে গেলে ভবিষ্যতে আমার মন খারাপ হতে পারে ভেবে রতন ভাই জোর করলেন সিনিক ওয়ার্ল্ড নামে পার্কে ঢুকে ৩টা এডভেঞ্চার রাইডে দেখার জন্য। সিনিক ওয়ার্ল্ডে প্রবেশ করার আগে খুব সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে নাস্তা সেরে নেই আমরা।

সিনিক ওয়ার্ল্ডেও টিকেটের দামটা কত মনে পড়ছেনা, তবে একবার ঢুকলে সিনিক ওয়ার্ল্ডের বিশ্ব বিখ্যাত পাহাড়ী ট্রেন, ক্যাবল কার ও সিনিক স্কাই ওয়ে নামে ৩টা অসম্ভব সুন্দর রাইড যতবার ইচ্ছা উঠা যায়। আমাদের একবার করে উঠার সময়ও হাতে ছিলো না। আমরা সিনিক ট্রেনে চেপে একবার পাহাড়ের নিচ থেকে ঘুরে আসলাম। আর একবার সিনিক ক্যাবলকারে করে পাহাড়ের অন্যপাশ পর্যন্ত ঘুরে আসলাম। বলা হয়, সিনিক ওয়ার্ল্ডেও ট্রেনটি পৃথিবার সবচেয়ে খাড়া ট্রেন সার্ভিস। যদিও এটাকে ট্রেন বলা যায় কি না আমার সন্দেহ আছে। আর আগে মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে এমন পাহাড়ী ট্রেনে চাপার অভিজ্ঞতা আমার ছিলো। এটাকে ঠিক ট্রেন না বলে একধরনের লিফট্ বলা যায়। পাহাড়ের দেয়ালে লাগানো লাইন বেয়ে একবার নেমে যায়, আবার সোজা উঠে আসে। কাঁচের জানালা দিয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে দেখতে হয় ব্লু মাউন্টেনের রুদ্ধশ্বাস সৌন্দর্য। ক্যাবলকার সার্ভিসটাও খুব সুন্দর।


মেঝেতে কাঁচ দেয়া জায়গা দাড়ালে কয়েকশো ফুট নিচের গাছ গুলো দেখে গা শিরশির করে উঠে যেন। সিনিক ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে ছোট একটা জলপ্রপাত দেখার জন্য কিছুটা সময় ব্যায় করি। সব মিলিয়ে জায়গাটা অসাধারণ ছিলো। আমার সময় খুব বেশি ছিলো না বলে ভালো মতো ঘুরা হয়নি ব্লু মাউন্টেনের অনেক কিছু। আবার আসবার আশা নিয়ে ব্লু মাউন্টেন দেখা শেষ করে সিডনি শহরের দিকে রওনা দেই। এরপর সরাসরি এয়ারপোর্ট। যাত্রাপথে বড় একটা মার্কেটে নেমে কিছু কেনা কাটা করে আর দুপুরের খাওয়া সেরে নেই। এবং সিডনির মনোমুগ্ধকর জায়গা গুলোর স্মৃতি সাথে করে মেলবোর্ণ শহরে ফিরে আসি।

 

লেখক: আনিসুল কবীর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top