সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

সোমেশ্বরী নদী ও কথোপকথন : ডা: মালিহা পারভীন


প্রকাশিত:
৭ জুলাই ২০২০ ২১:১১

আপডেট:
৬ আগস্ট ২০২০ ০৬:২৪

ছবিঃ লেখিকা

 

বিরিশিরি, সুসং দুর্গাপুর। বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার ছোট এক উপজেলা। নানা রকম বৈচিত্রে ভরা এই সুসং দুর্গাপুর। ইতিহাস সমৃদ্ধ, প্রাকৃতিক রুপ বৈচিত্রে ভরপুর, প্রাকৃতিক সম্পদের আধার এই লোকালয় পর্যটকদের জন্য পৃথিবীর অনেক জায়গার মতনই আকর্ষণীয়! সেই আকর্ষণে আমরা ৫ জনের ছোট একটা ভ্রমন দল ঢাকা থেকে এসেছি সুসং দুর্গাপুর বেড়াতে।

হেমন্ত ভোর। কুয়াশার চাদর ঢাকা চারিদিক। ছোট এক খেয়া নৌকায় আমরা ৫ জনের ভ্রমন দল পার হচ্ছি ছোট নদী। এই হালকা শীতে আমরা না কাঁপলেও নদীর পানি কাঁপছে বাতাসে থিরথির।

আমাদের ওপারে যেতে হবে । নদীর জল কেটে এগোচ্ছে নৌকা। রানীখং নামে সবুজ পাহাড়টির কোল ঘেঁষে আহ্লাদি শুয়ে আছে শান্ত এ নদীখানি। এক ধারে তার ধুধু বালুচর, অন্যধারে নীলাভ জল। মোহনীয় উদাস করা তার রুপ!

গুনগুনিয়ে উঠি আমি নিজের মনে 'ও নদীরে বল কোথায় তোমার দেশ?'
কলকল করে নদী জবাব দেয় --
'আমার নাম সোমেশ্বরী । ভারতের মেঘালয় রাজ্যে গারো পাহাড় যার আয়তন প্রায় ৮০০০ বর্গমাইল সেইখানেই আমার জন্ম। গারো পাহাড়ে আছে আছে অনেক ছোট বড় ঝর্না। নানা রকমার গাছ, নানা প্রজাতির পাখি। টিলার উপর ছোট ছোট কু্ঁড়েঘর যাতে আদিবাসীদের বাস। সব মিলে এই পাহাড়টি ব্যতিক্রমী ও অনন্য।

ছবিঃ সোমেশ্বরী নদী

সোমেশ্বরী নদী এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে জানালো যে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝর্ণাধারা ও পশ্চিমে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে তার জন্ম হয়েছে। এরপর হাজারো পথ- জনপদ পার হয়ে সুসং দুর্গাপুরে প্রবাহিত হয়ে এসেছে।

আমি শুনতে শুনতে সোমেশ্বরিকে প্রশ্ন করি :
: তোমার নামটা তো ভারী মিস্টি ! এ নাম তোমায় কে দিল গো !
সে উত্তর দেয় -
: সোমেশ্বর নামে এক সিদ্ধ পুরুষ ৬৮৬ বঙ্গাব্দে এ অঞ্চলকে বাইশা গারো নামে এক অত্যাচারীর শাসকের হাত থেকে মুক্ত করেছিল জাতিগত দ্বন্দ ও কলহের পর। সেই সিদ্ধ পুরুষের সম্মানে তাঁর নামে আমার নামকরন হলো সোমেশ্বরী।

আমি ডান হাতে ছুঁই সোমেশ্বরীর মায়াবী জল। প্রশ্ন করি -
: শুনেছি এখানে অনেক আদিবাসীরা বাস। তাদের সম্পর্কে কিছু বল।
ছলাৎ শব্দে ঢেউ এসে বলে যায় --
: এ অঞ্চলে অনেক আদিবাসী বাস করে। গারো, হাজং, কোচ, ডালু, মুরং ইত্যাদি। এ সম্প্রদায়ের লোকেরা যুগ যুগ ধরে নিজেদের কৃষ্টি-কালচার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার সাথে সৌন্দর্য ও সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস করে আসছে। তবে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, ব্যবসা বাণিজ্যে সর্বক্ষেত্রে এ এলাকাটি পিছিয়ে আছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে ১৯৭৭ সনে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে 'বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি'।

: সুসং দুর্গাপুরে আর কি কি দেখার আছে?

এই ছোট্র প্রায় ৩ হাজার ৩০০ বর্গমাইল আয়তনের সুসং দুর্গাপুর নিয়ে সোমেশ্বরীর যেন গর্বের অন্ত নাই। সে গ্রীবা বাঁকিয়ে বলতে শুরু করে --

: এক সময় দুর্গাপুর ছিল সুসং রাজ্যের রাজধানী। নদীর ওপারে বিজয়পুর পাহাড় যা দেশের একমাত্র চীনামাটির খনি। আছে নীল পানির লেক, ছোটবড় পাহাড়, পাহাড় বেয়ে ছোটবড় অসংখ্য ঝর্না। বিজয়পুর বিজিবি কাম্পও দেখা উচিত। হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ, সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী, রানিখং গ্রামের ক্যাথলিক গির্জা, বিস্তীর্ন সমতলে নানারকম শস্যভূমি -- কত কি!

সোমেশ্বরী নদীর ক্লান্তিহীন কথা শুনে কিছুটা ক্লান্ত আমরা দেখি নৌকা পারে ভিড়ে গেছে । কিছুদুর হেঁটে আমরা পাহাড় বেয়ে দেখতে গেলাম সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী। এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১২ সালে। রানিখং পাহাড়ের ক্যথলিক গির্জা, আদিবাসি, বাংগালি কচিকাচাদের কলকাকলিতে মুখর স্কুল দেখে আরো উঁচুতে বিজিবি ক্যাম্পে আসি - যেখান থেকে মেঘালয় পাহাড় দেখা যায়।

জায়গাটা পর্যটক বান্ধব নয় ব'লে লোকজনের পদচারনা কম। আজ আবার টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। কোলাহলমুক্ত, নির্মল পরিবেশ। আমরা যাচ্ছি এবার সাদা মাটির পাহাড় দেখতে। বিজয়পুরের শসার পাড় এবং বহেরাতলী গ্রামে প্রায় ১৫.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খনিজ অঞ্চল। চীনা মাটি সংগ্রহের কারনে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট স্বচ্ছ নীল রঙের জলাধার -- কি যে চমৎকার!

পুরো এলাকা জুড়ে সাদা, গোলাপী, হলুদ, বেগুনি, ছাই খয়েরী, নীলাভ বিভিন্ন রংয়ের মাটির পাহাড়, চেনা অচেনা গাছ, কোথাওবা গাঢ় সবুজ বিস্তীর্ন মাঠ নীল আকাশ মাথায় নিয়ে শুয়ে , সব মিলে এ এক অপুর্ব স্বপ্ন রাজ্য ! আমরা মুগ্ধ ও বিস্মিত !

আদিবাসিদের দু একটা কুড়ে ঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে। লেকের স্ফটিকস্বচ্ছ জল আয়নায় আমরা সবাই একবার মুখ দেখে নিলাম। বেগুনি বুনোফুল গুঁজে দেই চুলে । ' বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার প্রান --' দেখি আর দেখি চারিদিক।

দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকাল - ফিরতে হবে আমাদের। ফেরার পথে এবার ইঞ্জিন নৌকায় উঠে গেলাম। সোমেশ্বরীর সাথে আবার দেখা।

ছবিঃ সুসং রাজবাড়িএবার সোমেশ্বরীর কাছে সুসং দুর্গাপুরে অবলুপ্ত সুসং রাজবাড়ির গল্প। দেয়াল দিয়ে ঘেরা ও পরিখাবেষ্টিত এই রাজবাড়িতে ছিল সৈনিকদের আবাস, বিচারালয়, কারাগৃহ, অস্ত্রাগার, চিড়িয়াখানা, হাতিশালা, রাজপরিবারের সদস্যদের প্রাসাদ, শয়নকক্ষ, কাছারি, বৈঠকখানা ইত্যাদি। ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সুসং রাজ্যের রাজা জগতকৃষ্ণ সিংহ প্রাচীর চাপা পরে নিহত হন।এবং রাজবাড়ির প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতেভ ১৯৭০ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় 'সুসং ডিগ্রী কলেজ'।

ছবিঃ রাশিমনি স্মৃতি সৌধটি

সোমেশ্বরীকে আমি বললাম যে আমরা রাশিমনি স্মৃতি সৌধটিও দেখে এলাম ।
সে তখন আমাদের সামনে এক বিস্ময়ের ইতিহাস তুলে ধরলো -
: আদিবাসী হাজংদের বিপ্লবি নেত্রীর নাম ছিল রাশিমনি। ব্রিটিশ আমলে টংক আইন (ফসল হউক বা না হউক তার ভাগ মালিককে দিতে হবে এমন একটা আইন) জারি হবার ফলে হাজংসহ অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়, কৃষকসমাজ অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পড়ে। টংক প্রথা কৃষকদের জন্য ছিল একটি অভিশাপ। তাই তারা এ প্রথার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ বা আন্দোলন গড়ে তোলেন। তারা জমিদার গোষ্ঠীর সঙ্গে এবং পরে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দানে এগিয়ে আসেন কমরেড মণিসিংহ।


বহেরাতলী গ্রামে ক্ষিপ্ত বৃটিশ বাহিনী লংকেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী ও আন্দোলন কর্মী ১৭ বছরের কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যায়। এ সংবাদে দ্রুত হাজং নেত্রী রাশিমণি নারী-পুরুষ দল নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর পথরোধ করেন। এ সময় বিপ্লবী রাশিমণি হাজং কুমুদিনী হাজংকে বাঁচাতে সেই সশস্ত্র বাহিনীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই বলে, ‘ময় তিমাদ, তিমাদ হুয়ে আরেগ তিমাদলা মান ময় বাঁচাব, মরিবা লাগে মুরিব।’ অর্থ: ‘আমি নারী, নারী হয়ে আরেক নারীর সম্ভ্রম রক্ষা আমিই করব, মরতে হয় মরব।’ সশস্ত্র বাহিনীও তাদের ওপর গুলি চালালে এক সময় গুলিবিদ্ধ রাশিমণি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শহীদ হন আদিবাসী নেত্রী রাশিমণি হাজং।

অধিকার প্রতিষ্ঠা ও একজন নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে 'হাজংমাতা ' রাশিমনির আত্মত্যাগ আজও তাকে অমর করে রেখেছে। ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বহেরাতলী গ্রামের তার মৃত্যুসংলগ্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে এইব ‘হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ’। সব শুনে শ্রদ্ধায় ভালবাসায় মাথা নত হয়ে এলো অদেখা সেই আদিবাসি নারীদের জন্য।

আমাদের নৌকা তখন দুর্গাপুর বাজারের ঘাটে। পেটে খিধে জানান দিচ্ছে। দুর্গাপুরে মধ্য মানের কিছু খাবার হোটেল আছে। খাবারও মন্দ নয়। এই চিন্তার মাঝেই লক্ষ্য করলাম নদীকে ঘিরে নানা মানুষের নানা ব্যস্ততা। কেউ কেউ কোদাল ও বাঁশের খাঁচা নিয়ে নদী থেকে কয়লা তুলছে, কেউ তুলছে নুড়ি পাথর, কেউ পাথর ভাংগছে। জেলের দল মাছ ধরায় ব্যস্ত । শত শত ড্রেজার মেশিন নদীর পাড়ে ঘরঘর শব্দে বালু তুলে যাচ্ছে। নদির ঢেউ ছাপিয়ে যন্ত্রের এই শব্দ বাতাসকে ভারি করে তুলেছে।

সোমেশ্বরি ফিসফিস করে বললো -
এই যে আমার জন্য এতো মানুসের কর্মসংস্থান হচ্ছে, ব্যবসায়িরা ব্যবসা করছে, বালু, কয়লা, পাথর দিয়ে তোমাদের কাজে লাগছি তাতে নিজেকে ধন্য মনে হয়। কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ক'রে সব করা হচ্ছে না ব'লে কষ্ট হয় আমার!

সোমেশ্বরীরা শুধু দিয়েই যায় আর আমরা মানুষরা শুধু নিয়েই যাই। টিপটিপ বৃষ্টি মুক্তোবিন্দু হয়ে নদীর পানিতে টুপ টুপ ক'রে ঝরছে। আমরা ফিরে যাচ্ছি লোকালয়ে। পিছনে সরে যাচ্ছে নদী, পাথর, বালুচর, চিনেমাটির পাহাড়।

সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ পানিতে তখন মেঘের ছায়া। সোমেশ্বরী তখন যেন গাইছে--
'আমার চলা যায় না বলা, আলোর পানে প্রানের চলা --
আমি নদী আপন বেগে পাগল পারা ---' 

 

ডা: মালিহা পারভীন
কবি ও কথা সাহিত্যিক

সেগুনবাগিচা, ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top