সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিচারণে দগ্ধ নালন্দা! : তন্ময় সিংহ রায়


প্রকাশিত:
৩১ আগস্ট ২০২০ ২০:৩০

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৩২

ছবিঃ নালন্দা

 

প্রাচীন ভারতের মগধ নামক জনপদে (অধুনা ভারতের বিহার রাজ্য) অবস্থিত একটি খ্যাতনামা বৌদ্ধ মহাবিহার ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।  বর্তমান বিহারের রাজধানী পাটনা শহরের ৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এটি অবস্থিত। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দী থেকে আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নালন্দা মহাবিহার ছিল ভারত তথা সমগ্র বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্র। খ্রিস্টীয় ৫ম-৬ষ্ঠ শতাব্দীতে এটি বিকাশলাভ করেছিল গুপ্ত সম্রাটগণ এবং পরবর্তীকালে কনৌজ সম্রাট হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায়।

বিশ্বজোড়া খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা এক সু-উজ্জ্বল নক্ষত্রসম নালন্দা তৎকালীন পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করেছিল জ্ঞান চর্চা, আহরণ ও বিতরণের এক সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে।  তৎকালীন নালন্দার দ্বার ছিল জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে সকলের জন্য উন্মুক্ত!  কোনো ধরনের শ্রেণী, লিঙ্গ, বর্ণগত বৈষম্যের উপস্থিতির ছাপ সেখানে ছিল না। 

হিউয়েন সাংয়ের বিবরণ অনুযায়ী, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ২ জন নালন্দায় শিক্ষার সুযোগ পেত সে সময় এবং তা ছিল মেধার ভিত্তিতে। ভারত ছাড়াও ইন্দোনেশিয়ার শৈলেন্দ্র রাজবংশ-সহ কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, পারস্য ও তুরস্কের বিভিন্ন পণ্ডিত(স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত)ও ছাত্রগণ সেখানে আসতেন অধ্যাপনা ও অধ্যয়ন করতে।

নালন্দার ছাত্ররাও ছিল প্রাণবন্ত, শ্রদ্ধাবান, সুযোগ্য ও বিদ্যা উৎসাহী! বহুদুর থেকে তাঁরা এখানে ছুটে আসতো যেন বিদ্যা-তৃষ্ণা নিবারণের একান্ত উদ্দ্যেশ্যে। ৩০ একর জায়গা জুড়ে ৮০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৬০০ ফুট প্রস্থের বিশালায়তন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন ২০০০ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যাটি ছিলো ১০ হাজার।

প্রথাগত তিব্বতি সূত্র অনুসারে, নালন্দায় 'রত্নসাগর'(রত্নের মহাসাগর), 'রত্নদধি'(রত্নের সমুদ্র) ও 'রত্নরঞ্জক' (রত্নখচিত) নামক তিনটি বহুতলবিশিষ্ট ভবনের অস্তিত্বের কথা জানা যায় যা ছিল 'ধর্মগঞ্জ'(ধর্মের হাট) নামক একটি সু-বৃহৎ গ্রন্থাগারের অন্তর্ভুক্ত।

এর মধ্যে রত্নোদধি ছিল ৯ টি তলবিশিষ্ট একটি পাঠকক্ষ। 'প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র' ও 'গুহ্যসমাজ' নামক পবিত্রতম ধর্মগ্রন্থ এখানেই ছিল রক্ষিত। সম্পূর্ণ গ্রন্থাগার জুড়ে ঠিক কি পরিমাণ   বইপত্র ছিল তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভেষজবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ক

আনুমানিক লক্ষাধিক বহুমূল্যবান গ্রন্থাবলী ছিল এই নালন্দা গ্রন্থাগারে। 

বলাবাহুল্য, নালন্দায় অবস্থানকালে হিউয়েন সাং তাঁর বাসকক্ষের জানলার বাইরের দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন,

'সম্পূর্ণ মহাবিহারটি ইষ্টকনির্মিত একটি প্রাচীরের দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং এই প্রাচীরটি বাইরে থেকে ঘিরে রেখেছে সমগ্র মহাবিহারটিকে।  ১ টি মাত্র দ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে হয় এই মহৎ মহাবিহারে। মধ্যে অন্যান্য ৮ টি সভাগৃহ সেই মহাবিহার থেকে পৃথক অবস্থায় রয়েছে। সুসজ্জিত স্তম্ভ ও পরি-সদৃশ্য স্তম্ভশীর্ষগুলি একত্রে সূচালো পর্বতশীর্ষের ন্যায় সন্নিবেশিত। মনে হয় যেন, মানমন্দিরগুলি কুয়াশায় এবং স্তম্ভশীর্ষের কক্ষগুলি হারিয়ে গিয়েছে মেঘের মধ্যে!'

নালন্দার সঙ্গে যুক্ত কিছু বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ববর্গের মধ্যে, আর্যভট্ট, নাগার্জুন, আর্যদেব (নাগার্জুনের ছাত্র) অতীশ দীপঙ্কর, চন্দ্রকীর্তি (নাগার্জুনের ছাত্র), ধর্মকীর্তি, শীলভদ্র (হিউয়েন সাংয়ের শিক্ষক), হিউয়েন সাং, ইৎসিং, (চীনা বৌদ্ধ পর্যটক) প্রভৃতি উল্লেখ্য। 

 

সমগ্র বিশ্বের গর্ব ও ঐতিহ্যবাহী একটি স্থান কিভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়, তার জীবন্ত নজির হয়ে, ঝলসানো শরীরটা নিয়ে যন্ত্রণায় কাতর ও নিঃশব্দ আর্তনাদরত অবস্থায় আজও যেন দাঁড়িয়ে নালন্দা'টা!

পতনের পর নালন্দা তলিয়ে গিয়েছিল প্রায় বিস্মৃতির অতলে। ১৮১১-১৮১২ সাল নাগাদ স্থানীয় অধিবাসীরা সেই অঞ্চলে ধ্বংসস্তুপের একটি বিরাট চত্বরের দিকে ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলন (F.R.S, F.R.S.E, F.L.S, F.A.S, F.S.A & D.L)-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, তিনি সেই ক্ষেত্রটিতে, মাটি ও ভগ্নাবশেষকে কেন্দ্র করে সমীক্ষা চালিয়েও সেই স্তুপকে ঐতিহাসিক নালন্দা মহাবিহার হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেননি। 

অবশেষে চিহ্নিতকরণের সেই কাজটি ১৮৪৭ সালে সম্পন্ন করেন মেজর মার্কহ্যাম কিট্টো। সর্বশেষ আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম (Archaeological Survey of India-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম মহাপরিচালক) ও সদ্যগঠিত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সংস্থা (A.S.I) ১৮৬১-১৮৬২ সালে এখানে একটি সরকারি সমীক্ষা চালায়।

 

নালন্দা হয়তো শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতাতেই হয়ে যেতে পারতো স্তব্ধ!  কিন্তু একে পুনরুজ্জীবিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বৈজ্ঞানিক ড. এ পি জে আব্দুল কালাম।  আর তাঁর একান্ত প্রচেষ্টার ফলে আবারও প্রাণ ফিরে পেতে যাচ্ছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। 

ভারতীয় পার্লামেন্টে ২০১০ সালে একটি বিল পাশের মাধ্যমে পুনরায় এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে।

জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেওয়া হল এমন একটি গগনচুম্বী, বলিষ্ঠ বৃক্ষকে, যে বৃক্ষ ভবিষ্যতে ছায়া ও ফুল-ফল সর্বোপরি অফুরন্ত অক্সিজেন দিত হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মুসলমান, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু প্রভৃতিকে।

ভুলকে ভুল আর অন্যায়কে অন্যায় বলাটা পরিচয় বহন করে অধিক বীরত্ব ও সম্মানের, তা সবাই পারে না, করে না! নালন্দার মৃত্যু সম্পর্কিত সর্বশেষ একথাই উল্লেখ্য যে, যদি আগুন থাকে ছাই চাপা, একদিন তার উদগিরণ হবেই।

'তাবাকত-ই-নাসিরী'র রহস্যময় কক্ষের দরজাটা আজও পড়ে আছে প্রায় বন্ধ অবস্থায়!

 

তন্ময় সিংহ রায়
কোলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top