সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ভ্রমণ কাহিনী: টপকাপি প্রাসাদ আর মানুষ দেখা (পর্ব ২)


প্রকাশিত:
৩১ মার্চ ২০২০ ১৯:৪৬

আপডেট:
৩১ মার্চ ২০২০ ১৯:৫২

ছবি: লেখক

আজ খুব ভোরে ‌অঝোরে বৃষ্টি হলো, আর হবেই বা না কেন? আমি শহরে না! আমরা নাস্তা সেরে যখন ট্যাক্সি নিয়ে বের হলাম তখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে! বড় মেয়ে বলল “মা এদের সবার গায়ের রং এত ফর্সা কেন? ওরা মুসলিম না?! “এবং সে আমাদের সাথে তুলনা করে নিশ্চিত বলেনি। ককেশিয়ানদের সাথেই তুলনা করলেও এরা বেশী সাদা, ‌অসিদের থেকে তো অবশ্যই! তবে টার্কিশ জাতি মানুষ হিসেবে বেশ ভালো তা এ কদিনেই বেশ বুঝলাম। গায়ের রং যাই হোক! হোটেল কর্মচারী রেস্টুরেন্ট মালিক, দোকানদার বা ট্যাক্সিচালক যতজনের সাথে আমাদের এ পর্যন্ত লেনদেন করতে হলো সকলেই খুব অমায়িক আর সর্বোপরি সৎ! এই সততার ‌অনুপস্থিতি যে কতটা ক্ষতিকারক ভ্রমণকারীদের জন্যে তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি, চীনে, সাউথ কোরিয়া, গ্রীসে, ফ্রান্স, স্পেনসহ আরও অনেক দেশে!

হোটেলে ব্রেকফাস্ট বুক করা মানে আমার জন্যে বিশাল এক বিড়ম্বনা, জীবনে প্রাতরাশের কোন অভ্যাসই আমার নেই! শুধু এক কাপ চা আর একটা বিস্কুট খেয়ে লাঞ্চ অবধি কাজ করি! সকলের সঙ্গে প্রাতরাশে যাই আর লোভনীয় সব খাবার দেখে না খেয়েও পারি না! তাতেই শেষ নয়, লাঞ্চ, কফি ব্রেক, হাল্কা কিছু খাবার ডিনারের আগে আবার ডিনারের পরে ডেসার্ট! বেড়াতে বের হলে এরা যে কি পরিমাণ খাদক হয় তা নিজ চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না! আর দু সপ্তাহে বাংলাদেশ যাবার সময় হতে হতে আমি গড়িয়ে গড়িয়েই মনে হয় যেতে পারব! ব্রেকফাস্টটা আসামাত্রই ম্যানেজার আমাকে বলল “ you’ve got an amazing smile ! “ অতঃপর মোটামুটি উদারচিত্তে প্রাতরাশ সেরে এবং চা পান করে আমরা ট্যাক্সি করে ব্লু মস্ক আর টপকাপি প্রাসাদ দেখতে বের হলাম। সামান্য মেঘ আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আমাদের দমিয়ে রাখতে পারল না! আমার অভ্যাস বা বদভ্যাস যাই মানুষ মনে করুক না কেন, কারো সাথে চোখাচোখি হলেই হাসি! মানে আর কিছু নয় -আমি তার শুভকামনা করি।

ব্লু মস্ক দেখে আমরা মুগ্ধ আর এর নামের অর্থ সাগরের নীল রং যখন মসজিদের গায়ে পড়তো তখন সেইলররা সেটাকে নীল রং বলে মনে করতো, সেভাবে হয়েছে অথবা ভেতরের নীল টায়েলস এর কাজ থেকে। কিন্তু ভেতরে নীল টায়েলস অন্য রঙের চাইতে বেশী প্রাধান্য তো পায়নি বলেই মনে হলো! আমার বড় কন্যা নীল রং খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে বলল “আজ মেঘলা দিন বলে এমন দেখাচ্ছে, আমরা আর একদিন ভাল দিনে আবার এখানে আসব”।

বিশাল টপকাপি প্রাসাদ আমার পরিবারের বাকী তিনজন বড্ড মনযোগ সহকারে দেখছে। দেখবেই বা না কেন? দারুন প্রাসাদ, সমুদ্র পাড়ে একেবারে! আমি বেশ অমনোযোগী, কিন্তু আমার খেয়াল ‌অন্যদিকে - আমি দেখি মানুষ! প্রাসাদে ঢুকছে সবাই তড়িঘরি, আমি বৃষ্টির মাঝেও আটকে গেলাম। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ছোট একটা কারটে কিভাবে শুধু অল্পদামে চেষ্টনাটস বিক্রি করছে! তাঁর সংসার চলে কিভাবে? সে তো আপাত সুখী মনে হলো বিশাল রাজপ্রাসাদের বাইরেও তাঁর ছোট্ট ফেরী নিয়ে!

অটোম্যান রাজত্ব আর সব রাজত্বের মতনই তো! একজন সুলতানই বেশী কাজ করে গেছেন, এক্ষেত্রে সুলতান মেহমিট। রাজ্য জয়, প্রাসাদ নির্মান, প্রজাদের মন জয় - বাকীরা সব ভোগ করে গেছেন অথবা ধ্বংস করেছেন! একই তো সব কামরাগুলো, অফিসিয়াল বৈঠক কামরা, প্রাইভেট কামরা, সুলতানের কামরা, তাঁর মাতার, রাণীর কামরা!! তবে একটা জায়গায় এসে আমারও ভালো লাগল। দেখলাম হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর পায়ের দাগ আর তাঁর দাঁড়ি স‍ংরক্ষন করা রয়েছে। আর কাবা শরীফের মডেল, তার চাবিও সেখানে!তখন কোরআন তেলাওয়াতের শব্দ আসছিল, ভাবছিলাম বুঝি রেকর্ড বাজছ! পাশের কামরায় ঢুকে দেখি এক ভদ্রলোক সুরেলা কন্ঠে নিজে তেলাওয়াত করছেন। উনি মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। আমি আসলে দেখি মানুষ ....

(চলবে)

লেখক: শাহনাজ পারভীন
(সিডনি, অস্ট্রেলিয়া)


 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top