আনিসুল কবীরের বুক রিভিউ: ঘুম ঘোরে ঘোরাঘুরি


প্রকাশিত:
২ এপ্রিল ২০২০ ০৫:৪৩

আপডেট:
৭ এপ্রিল ২০২০ ২৩:৫১

আনিসুল কবীর

অনন্যা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত শেগুফতা শারমিনের ঘুম ঘোরে ঘোরাঘুরি বইটি পড়তে গিয়ে পাঠক নিজেই এক ধরনের ঘোরের মধ্যে চলে যেতে পারেন। আমি নিজে ভ্রমণ করতে পছন্দ করি, লিখতেও। বইটি পড়তে গিয়ে আমি কখনও দার্জিলিংয়ের মিরিক লেকের পাশে দাদা বৌদির রেস্তোরায় রুই মাছের ঝোল দিয়ে ডিনার করেছি, কিংবা জাপানের নিক্কোতে লেখকের ভ্রমন সঙ্গী হয়ে ঝর্নার গানে বিভোর হয়েছি। ছোট ছোট ঘটনা নিয়ে ঠাস বুনোটে লেখা বইটি ভ্রমনকাহীনি হিসেবে ব্যতিক্রম। লেখার ষ্ট্যাইলের কারনে একবারও মনে হয়নি পর্যটকদের জন্য লেখা কোন ভ্রমন গাইড পড়ছি। লেখাগুলোর সাহিত্য মুল্য অপরিসীম বলে মনে হয়েছে।

কোথায় যাবেন, কোথায় খাবেন টাইপের বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে অদ্ভুত সুন্দর ভাবে নিজের ভালোলাগা ফুটিয়ে তুলেছেন পাতায় পাতায়।  অতি বর্ণনা বা তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত না করে নিজের ভালোলাগার অনুভূতিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন প্রতিটি লেখায়। একটা লেখার সাথে আরেকটার সামঞ্জস্যতা খুজতে গেলে পাওয়া মুশকিল হবে, কিন্তু দেখা গেছে পাশাপাশি দুটি কাহিনী হয়তো একই জায়গা নিয়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু লেখার বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন।  অভিজ্ঞ পাঠক কিংবা ভ্রমণপ্রিয় অনেক মানুষ যারা ভ্রমনকে শুধু জায়গার নাম দিয়ে বিচার করেনা, বুড়ি ছোয়ার মতো এদিক ওদিক দৌড়া দৌড়ি না করে ভ্রমনের সাথে সাথে সেই এলাকার মানুষ, প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতিটা অনুভব করার চেষ্টা করেন। তাদের জন্য বইটি হতে পারে লোভনীয় পাঠ উপকরন।

ঘুম ঘোরে ঘোরাঘুরি লেখাগুলো মুলত দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু জায়গা আর উপমহাদেশ থেকে দুরের কিছু দেশে ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা বইটিতে লিপিবন্ধ করা হয়েছে। কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক লেখা না সাজিয়ে পছন্দের যায়গা গুলোতে বিভিন্ন সময়ে করা ভ্রমণ নিয়েই সাজিয়েছেন একদম নিজের মতো করে। লেখার শুরুতেই বইটির নামকরন করেছেন দার্জিলিংয়ের ঘুম নামক জায়গাটির সাথে মিলিয়ে। শুরুতেই মনে হতে পারে দার্জিলিং এবং আশপাশের জায়গা গুলোর ব্যাপারে একটা বিশেষ দুর্বলতা আছে লেখকের, কিন্তু ধীরে ধীরে অন্য লেখাগুলো পড়ার পর মনে হয়েছে প্রতিটি জায়গাকেই একই প্রাধান্য আর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ইউরোপ নিয়ে সবচেয়ে বেশি লেখা স্থান পেয়েছে বইটিতে।

সড়ক পথে ইউরোপে ভ্রমনের সময় যেমন কখন কোন দেশে আছি বোঝা কষ্টকর, ঘোরার জায়গা হিসেবেও ইউরোপের তুলনা পাওয়া মুসকিল। তাই ইউরোপের বেশ অনেক দেশের কথাই এসেছে বইটিতে। সাথে সাথে উঠে এসেছে ঐসব এলাকার প্রাকৃতিক, মানবিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক ইস্যুগুলো। এছাড়াও অনেক লেখাতে পশ্চিম বঙ্গের রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া কিংবা জাপানের মানুষের প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, ফ্রান্সের কালো মানুষের জীবন সংগ্রাম, ভিয়েতনাম যুদ্ধ কিংবা হিরোশিমায় পারমানবিক বোমা বিস্ফোরনের ভয়াবহতা অনেক কিছুই এই আপাতনিরিহ ভ্রমনকাহীনিগুলোতে পরিস্কার ভাবে উঠে এসেছে।

কলেবরের দিক থেকে বইটিকে কোন মতেই ছোট বলা যাবেনা। ১৫২ পাতায় ২২টি ছোট ছোট ভ্রমণকাহীনি নিয়ে ছাপা হয়েছে ঘুম ঘোরে ঘোরাঘুরি বইটি। আগেই বলেছি, লেখক কোন পরিকল্পনা বা মাপঝোকের দিকে না গিয়ে নিজের পছন্দের জায়গা নিয়েই লিখেছেন বইটি। বাংলাদেশের সবেধন নীলমনি একটি লেখাই আছে বইটিতে, যেখানে গাইড ট্যুরের মিলন ছড়ি রিসোর্টের বম ঘরে বসে বৃষ্টি দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে। পড়তে পড়তে আরও একটি বিষয় খেয়াল হলো যে পুরো বইটিতে পাহাড়ের জয় জয়কার। বেশিরভাগ লেখায় পাহাড় আর মেঘের উপস্থিতি। বইটির অনেক পাতাই যেন মেঘের জলে ভেজা। মেঘ, ঝর্না কিংবা আঁকাবাকা রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে এসেছে সমতলের কোলকাতা, শান্তিনিকেতন, প্যারিস কিংবা ভেনিস। লেখকের পছন্দের তালিকায় সমুদ্রের চেয়ে পাহাড়ী এলাকার সংখ্যাই হয়তো বেশি।  

দামি কাগজের পাতায় পাতায় চাররঙা ছবি সহ সুপাঠ্য বইটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ভ্রমন সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলা যেতে পারে।

বইটি সহজে পেতে রকমারি ডট কমের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।                    



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top