সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

দ্যা প্রফেট (শেষ অনুচ্ছেদ) : কাহলীল জীবরান 


প্রকাশিত:
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৫১

আপডেট:
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৫৪

ছবিঃ কাহলীল জীবরান এবং অনুবাদক রোজীনা পারভীন বনানী 

 

সপ্তবিংশতি

তখন ছিল সন্ধ্যা। ধর্মযাজিকা আলমিট্রা বললেন, শুভ হোক এই দিন এই জায়গা এবং আপনার আত্মা যা এতক্ষণ কথা বলছিল।

তিনি উত্তর দিলেন, যে কথা বলছিল সে কি আমি ছিলাম? আমি কি একজন শ্রোতাও ছিলাম না? তারপর তিনি উপাসনালয়ের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলেন এবং সমস্ত জনতা তাঁকে অনুসরণ করল এবং তিনি জাহাজের কাছে গেলেন এবং ডেকের উপর উঠে দাঁড়ালেন। তিনি পুনরায় জনতার মুখোমুখি হলেন, তাঁর স্বরকে উচ্চে চড়ালেন এবং বললেন:

অরফালেজবাসী, বাতাস আমাকে আদেশ করছে তোমাদেরকে ত্যাগ করার জন্য। আমি বাতাসের চেয়ে কম দ্রুত, তথাপিও আমাকে অবশ্যই যেতে হবে। আমরা ভ্রমণকারীরা, সবসময় নির্জনতর রাস্তাকে খুঁজি, কোন দিন শুরু করিনা যেখানে আমরা অন্য একটা দিনকে শেষ করেছি; এবং কোন সূর্যোদয় আমাদের দেখবে না যেখানে সূর্যাস্ত আমাদের ছেড়ে গেছে।

যখন পৃথিবী ঘুমায় তখন আমরা ভ্রমণ করি।

আমরা সংসক্ত গাছের বীজ, এবং আমাদের হৃদয়ের পরিপক্ব এবং পরিপূর্ণ অবস্থায় আমাদেরকে বাতাসের ভিতর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তোমাদের মাঝে আমার দিনগুলো ছিল সংক্ষিপ্ত এবং এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত কথা আমি উচ্চারণ করেছি তা ছিল সংক্ষিপ্ততর কিন্তু যখন তোমাদের কানে আমার স্বর ম্লান হয়ে যাবে এবং তোমাদের স্মৃতি থেকে আমার ভালোবাসা অদৃশ্য হয়ে যাবে, তারপর আমি আবার ফিরে আসব এবং আরও সমৃদ্ধ হৃদয় নিয়ে আত্নার আরও বশ্য ঠোঁটে কথা বলব।

হ্যাঁ, আমি স্রোতের সংগে ফিরে আসব, এবং যদিও মৃত্যু আমাকে লুকিয়ে ফেলবে, এবং সর্বোচ্চ নৈঃশব্দ্য আমাকে ঘিরে ধরবে, তথাপি আমি পুনরায় তোমাদের বোঝাবুঝিকে খুঁজব।

আমি খুঁজব কিন্তু মূল্যহীনভাবে নয়। আমি যা বলেছি যদি তার সামান্য কিছুও সত্য হয়, সেই সত্য আরও সুস্পষ্ট স্বরে এবং সশব্দে তোমার চিন্তায় নিজেকে প্রতিভাত করবে।

অরফালেজবাসী, আমি বাতাসের সংগে চলে যাব, কিন্তু আমি শূন্যতার ভিতর নিপতিত হব না এবং যদি আজকের দিনে তোমাদের প্রয়োজন এবং আমার ভালবাসা পরিপূর্ণ না হয়, তাহলে ধরে নাও এটা অন্য আর একদিনের প্রতিজ্ঞা।

মানুষের প্রয়োজন বদলায়, কিন্তু তার ভালবাসা নয়, বাঁচার আকাঙ্খাও নয় যাতে তার ভালবাসা তার প্রয়োজনকে মেটাতে পারে। সুতরাং, জেনে রাখ, আরও বেশী নৈঃশব্দ্য থেকে আমি ফিরে আসব। যে কুয়াশা ভোরবেলাকে আচ্ছন্ন করে, যদিও অদৃশ্য হয়ে যায় কিন্তু শিশিরবিন্দু হয়ে মাঠে জমা হয়, তারপর বাষ্প হয়ে উপরে উঠে সৃষ্টি করে মেঘ। এবং আবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে।

আমি কুয়াশার মতই তোমাদের ভিতর ছিলাম।

রাত্রির নৈঃশব্দ্যের মধ্যে আমি তোমাদের রাস্তায় হেঁটেছি, এবং আমার আত্মা তোমাদের গৃহে প্রবেশ করেছে, তোমাদের হৃদকম্পন ছিল আমার হৃদয়ে, এবং তোমাদের নিঃশ্বাস পড়েছে আমার মুখের উপর, এবং আমি তোমাদের সকলেই জানি ।

হ্যাঁ, আমি তোমাদের আনন্দ এবং বেদনা দুটোই জানি, এবং তোমাদের ঘুমের ভিতর তোমাদের স্বপ্ন ছিল আমারই স্বপ্ন।

মাঝে মাঝে আমি তোমাদের ভিতর ছিলাম যেমন পাহাড়ের ভিতর হ্রদ থাকে। আমি তোমাদের ভিতর শীর্ষদেশের প্রতিফলন এবং বাঁকানো ঢাল দেখেছি, এবং একইভাবে তোমাদের চিন্তা এবং আকাঙ্ক্ষার প্রবাহিত বাঁক দেখেছি।

আমার নৈঃশব্দ্যের ভিতর তোমাদের শিশুদের হাস্যধ্বনী ঝরনার মত ভেসে আসে, এবং তোমাদের যুবকদের আকুল কামনা নদীর মত এবং যখন তারা আমার গভীরে পৌছাঁয় তখন সেই নদী এবং ঝরনার গান থামে না। তখন সেই হাস্যধ্বনী আরও সুমধুর হয়ে এবং আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়ে আমার কাছে আসে।

যা তোমাদের ভিতর ছিল সীমাহীন; তোমরা সকলেই আছ একজন বিশাল মানুষের মাঝে কোষে এবং মাংসপেশীতে; তোমরা তোমাদের সমস্ত গানে তার স্তব কর কিন্তু একটা শব্দহীন কম্পনের মাধ্যমে যাতে তুমি বিশাল হতে পার সেইজন্যই সে বিশাল, এবং তাকে দেখে আমি তোমাদেরকে দেখলাম এবং ভালবাসলাম।

ভালবাসা কত দূরত্ব পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে যা এই বিশাল গোলকে নেই?
কোন দৃষ্টি, কোন আশা এবং কোন ধারনা এই যাত্রাকে উর্ধ্বলোকে অতিক্রম করতে পারে?

আপেল ফুলে আবৃত বিশাল ওক গাছের মতই তোমার ভিতরের বিশাল মানুষটি। তার ক্ষমতা তোমাকে পৃথিবীর সাথে বেঁধে রাখবে, তার সুগন্ধ তোমাকে মহাশূন্যে ছড়িয়ে দেবে, এবং তার স্থায়ীত্বই তোমাকে মৃত্যুহীন করে দেবে। তোমাদেরকে বলা হয়েছে, তোমরা একটা শিকলের মত, তোমরা দুর্বল যেহেতু দুর্বলতম বাঁধনের সাহায্যে যুক্ত। এটা অর্ধেক সত্য। একই রকমভাবে তোমরা শক্তিশালী যেহেতু শক্তিশালী বাঁধনের মাধ্যমে যুক্ত। তোমাকে পরিমাপ করা তোমার ক্ষুদ্রতম কাজের দ্বারা যেন সমুদ্রের শক্তি হিসাব করা তার ভঙ্গুর ফেনার দ্বারা। তোমাকে বিচার করা তোমার ব্যর্থতার দ্বারা যেন ঋতুকে দোষারোপ করা তার পরিবর্তনশীলতার জন্য।

হ্যাঁ, তোমরা একটা সমুদ্রের মত এবং যদিও মাটি সংলগ্ন ভারী জাহাজ তোমার তীরে স্রোতের জন্য অপেক্ষা করছে, তথাপি সমুদ্রের মত তুমি তোমার স্রোতের জন্য তাড়াহুড়া করোনা এবং অধিকন্তু তুমি ঋতুর মত এবং যদিও তোমার শীতে তুমি তোমার বসন্তকে অস্বীকার কর, তথাপি বসন্ত, তোমার ভিতরে বিশ্রামরত, এবং বিরক্ত না হয়ে ঘুমের ঘোরে হাসছে।

কখনো চিন্তা করোনা আমি এই সব বলছি এজন্য যাতে তোমরা একে অন্যকে বলতে পার, “তিনি আমাদের উত্তমভাবে প্রশংসা করেন এবং শুধু আমাদের ভিতরের ভালটাকেই দেখেন”। আমি তোমাদেরকে শুধু সেই কথাগুলোই বলেছি যেগুলো তোমরা নিজেরাই তোমাদের চিন্তায় জানতে।

সশব্দ জ্ঞান কী একটা শব্দহীন জ্ঞানের ছায়া ?

তোমাদের চিন্তা এবং আমার কথা একটা সীলমোহর করা স্মৃতি থেকে তরঙ্গায়িত হয় যা আমাদের গতদিনের স্মৃতিকে লিপিবদ্ধ করে রাখে, এবং পুরনো দিনের স্মৃতিকেও যখন পৃথিবী আমাদেরকে এমনকি নিজেকেও জানত না, এবং সেসব রাতের স্মৃতিকেও যখন বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পৃথিবীকে তৈরী করা হয়েছিল।

জ্ঞানী লোকরা তোমাদের কাছে এসেছে তাদের জ্ঞান তোমাদেরকে দেওয়ার জন্য। আমি এসেছি তোমাদের জ্ঞানকে গ্রহণ করার জন্য: 

এবং আমি যা দেখেছি তা জ্ঞানের চেয়েও অনেক বড়। এটা তোমাদের ভিতর আত্মার একটা শিখা যা সবসময় নিজেকেই বেশী জড়ো করবে, যখন তুমি এর বিস্তৃতির ব্যাপারে অমনোযোগী, তোমার হারিয়ে যাওয়া দিনের জন্য বিলাপ কর।

সে জীবন, যা দেহের ভিতর জীবন অন্বেষণ করে তা সমাধিকে ভয় করে।

এখানে কোন সমাধি নেই ।

এই সমস্ত পাহাড় এবং সমভূমি এক-একটি দোলনা এবং প্রতিটি পাথর এক একটি পা ফেলবার পাটাতন। যখন তোমরা মাঠের পাশ দিয়ে যাবে যেখানে তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের শুইয়ে রেখেছ সেখানে ভালভাবে লক্ষ্য কর, এবং তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের সন্তানদের দেখতে পাবে যারা পরস্পর হাত ধরাধরি করে খেলছে।

প্রকৃতপক্ষেই তোমরা মাঝে মাঝে না জেনে আনন্দিত হও। অন্যান্যরা তোমাদের কাছে এসেছে যাদেরকে তোমরা সম্পদ, শক্তি ও গৌরব দিয়েছ এইজন্য যে তারা তোমাদের বিশ্বাসের বুনিয়াদের উপর স্বর্ণালী প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করেছিল।

আমি তোমাদেরকে একটা প্রতিজ্ঞারও কম দিয়েছি এবং তথাপি আরও সৌজন্য তোমরা আমার প্রতি দেখিয়েছ।

তোমরা আমাকে দিয়েছ জীবনের প্রতি গভীরতম তৃষ্ণা। সত্যিকারভাবে একজন মানুষের কাছে যে জিনিষ তার সমস্ত উদ্দেশ্যেকে তৃষ্ণার্ত ঠোঁটে এবং সমস্ত জীবনকে একটা ঝরনায় পরিবর্তিত করে তারচেয়ে বড় উপহার আর কিছু নেই।

এবং এর ভিতরেই নিহিত আমার সম্মান এবং আমার পুরস্কার, আর যখন আমি ঝরনার কাছে আসি পানি পান করার জন্য তখন দেখি জীবন্ত পানি নিজেই তৃষ্ণার্ত; এবং সে আমাকে পান করে যখন আমি তাকে পান করি।

তোমাদের ভিতর অনেকেই আমাকে উপহার গ্রহণ করতে গর্বিত এবং অতিশয় লজ্জিত দেখ। প্রকৃতপক্ষেই আমি প্রতিদান গ্রহণ করতে যতটা না গর্বিত কিন্তু উপহার গ্রহণে ততটা নয় এবং তবুও তোমরা আমাকে তোমাদের খাবার টেবিলে বসিয়েছিলে, যদিও আমি পাহাড়ের মাঝ থেকে বেরী খেয়েছিলাম, এবং যখন তোমরা আমাকে সানন্দে আশ্রয় দিয়েছ, যদিও আমি মন্দিরের বারান্দায় ঘুমিয়েছি, তথাপি এটা কি আমার দিন এবং রাত্রির প্রতি তোমাদের মনোযোগপূর্ণ ভালবাসা ছিল না যা আমার খাদ্যকে সুমধুর করেছে এবং আমার ঘুমকে স্বপ্ন দিয়ে জড়িয়েছে?

এইজন্য আমি তোমাদেরকে সর্বোত্তম আশীর্বাদ করি:

প্রকৃতপক্ষেই যেই বদন্যতা আয়নার ভিতর নিজের দিকে স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাই পাথরে পরিণত হয়ে যায়, এবং একটা ভাল কাজ যে নিজেকে কোমল নামে ডাকছে তাই ধ্বংসের উৎস হয়ে যায়।

তোমাদের মাঝে অনেকেই বলেছে আমি নিজের একাকীত্বের মাঝে মত্ত অবস্থায় দূরে সরে আছি, এবং তোমরা বলেছ, “তিনি জংগলের বৃক্ষদের নিয়ে পরিষদ তৈরী করেছেন, কিন্তু মানুষের দ্বারা নয়।”

“তিনি পাহাড়ের চূড়ায় একাকী বসে আছেন এবং নীচে আমাদের নগরের দিকে তাকিয়ে আছেন।”

এটাই সত্য যে আমি পাহাড়ে চড়েছি এবং বিভিন্ন দূরত্বে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি কিভাবে এত উচ্চতা এবং এত দূরত্ব ব্যাতীত তোমাদেরকে দেখতে পারতাম? সত্যিকার অর্থেই কিভাবে একজন নিকটে আসতে পারে যতক্ষণ না সে দূরে যায়? এবং তোমাদের মাঝে অন্যান্যরা আমাকে বলে; কিন্তু শব্দে নয়, এবং তারা বলে, “আগন্তুক, আগন্তুক, অনতিক্রম উচ্চতার প্রেমিক, কেন আপনি এতটা শীর্ষে বসবাস করছেন যেখানে ঈগল তাদের বাসা তৈরী করে?”

“কেন আপনি অলভ্য বস্তু খুঁজছেন?”
“কোন ঝড়কে আপনি আপনার জালে আটকাতে চান,”
“এবং আকাশের কোন বাষ্পায়িত পাখিকে আপনি শিকার করতে চান?”
“এবং আসুন এবং আমাদের একজন হয়ে যান।”
“নীচে নামুন এবং আমাদের রুটি দিয়ে ক্ষুধা প্রশমিত করুন এবং আমাদের পানীয় দিয়ে আপনার তৃষ্ণা মেটান।”

তাদের আত্মার নির্জনতায় তারা এই সমস্ত কথা বলেছে; কিন্তু যদি তাদের নির্জনতা আরো গাঢ় হতো তারা জানতে পারতো যে আমি খুঁজছি তোমাদের আনন্দ এবং বেদনার গোপনীয়তাকে, এবং আমি শুধুমাত্র তোমাদের বৃহত্তর সত্তাকে শিকার করেছি যা আকাশে চরে বেড়ায়।

কিন্তু শিকারী নিজেও শিকারে পরিণত হয়েছে; আমার অনেক তীর আমার ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে শুধু আমার বক্ষকে খুঁজতে। এবং অতি দ্রুতগামী জিনিষও ধীরগতিতে পরিণত হয়, যখন আমার ডানা সূর্যালোকে বিস্তৃত হয়েছিল তার ছায়া পৃথিবীর উপর পড়েছিল একটা কচ্ছপের মত।

আমি ছিলাম বিশ্বাসী একই সঙ্গে সন্দিহানও; প্রায়ই আমি আমার আঙুল আমার ক্ষতের উপর রেখেছি যাতে করে আমি তোমাদের প্রতি গভীরতর বিশ্বাস এবং গভীরতর জ্ঞান অর্জন করতে পারি।

এবং যা আমি বলি তা এই বিশ্বাস এবং জ্ঞানের সাথে, তোমরা তোমাদের দেহের ভিতর বদ্ধ নও অথবা তোমাদের মাঠ এবং গৃহের ভিতর বন্দী নও। আসলে তুমি বসবাস কর পাহাড়ের চূড়ায় এবং তুমি ঘুরে বেড়াও বাতাসের সাথে। এটা সেই জিনিষ নয় যা সূর্যের ভিতর হাঁমাগুড়ি দেয় উষ্ণতার জন্য অথবা নিজেকে রক্ষার জন্য অন্ধকারের ভিতর গর্ত খোঁড়ে, কিন্তু একটা মুক্ত জিনিষ, একটা আত্মা যা পৃথিবীকে আচ্ছাদিত করে এবং মেঘলোকের ভিতর চলাচল করে।

যদি এগুলো অস্পষ্ট শব্দ হয়, তাহলে তাদেরকে পরিষ্কার করতে সচেষ্ট হয়ো না।

সমস্ত জিনিষের শুরুই অনিশ্চিত এবং অস্পষ্ট, কিন্তু তাদের সমাপ্তি নয়, এবং আমি আনন্দিত হব যদি তোমরা আমাকে প্রারম্ভ হিসাবে মনে কর।

জীবন এবং সমস্ত জীবন্ত জিনিষ, কুয়াশার ভিতর ধারণ করা হয় এবং কেলাসিত অবস্থায় নয়। এবং কে জানে একটা কেলাস পচে যাওয়ার পর কুয়াশা হয়ে যায় না?

সম্ভবত তোমাদের স্মৃতিতে আমাকে স্মরণ করবার সময় স্মরণ কর:

তোমার ভিতরের যে জিনিষকে সবচেয়ে বেশী দূর্বল এবং বিভ্রান্তিকর মনেহয় তাই সবচেয়ে শক্তিশালী এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এটা কি তোমার নিঃশ্বাস নয় যা তোমার হাড়ের গঠনকে ঋজু ও শক্ত করেছে?

এবং এটা কি একটা স্বপ্ন নয় যে স্বপ্নটা তোমরা দেখেছ বলে স্মরণে আসে না, যা তৈরী করেছে তোমাদের এই নগর এবং এর ভিতরের সব কিছু?

যদি তোমরা এই নিঃশ্বাসের স্রোত দেখতে পার তাহলে তোমরা অন্য সবকিছু দেখা থেকে বিরত হবে এবং যদি তোমরা স্বপ্নের শিষ শুনতে পার তাহলে তোমরা অন্য কোন শব্দ শোনা থেকে বিরত থাকবে কিন্তু তোমরা দেখ না, অথবা শোন না, এবং এটাই ভাল।

যে ঘোমটা তোমার চোখকে মেঘাচ্ছন্ন করেছে তা সরাতে পারবে সেই হাত যে একে বয়ন করেছে, এবং যে কাদা তোমার কানকে পূর্ণ করেছে তা ছিদ্র করতে পারবে সেই আঙুল যা একে দলাই-মলাই করেছে।

এবং তুমি দেখতে পাবে।
এবং তুমি শুনতে পাবে।

তথাপি তোমার অন্ধত্ব জানার পরও তুমি বিলাপ করোনা, অথবা তোমার বধিরতার জন্য দুঃখ করো না। এই দিনে তোমরা সমস্ত জিনিষের ভিতর লুকানো উদ্দেশ্য জানতে পারবে, এবং তোমরা অন্ধকারকে আশীর্বাদ করবে যেমন তোমরা আলোকে কর।

এই সব কথা বলার পর তিনি নিজের চারিদিকে তাকালেন, এবং তিনি দেখলেন জাহাজের কাপ্তান হাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে এবং স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বায়ুভরা পালের দিকে এবং পরমুহূর্তেই দূরে।

তখন তিনি বললেন:
ধৈর্যশীল, অতিরিক্ত ধৈর্যশীল আমার জাহাজের কাপ্তান।
বাতাস বইছে, এবং অস্থির হয়েছে পাল।
এমনকি হাল আদেশের প্রার্থনা করছে।
তথাপি আমার কাপ্তান শান্তভাবে আমার নীরবতার জন্য অপেক্ষা করছে।
এবং এই আমার নাবিকরা, যারা গভীর সমুদ্রের গান শুনেছে, তারাও সহিষ্ণুতার সংগে আমার কথা শুনেছে।
এখন তারা আর অপেক্ষা করতে রাজী নয়।
আমি প্রস্তুত।
ছোট নদী সাগরে মিশেছে, এবং আরও একবার মহান মাতা তার সন্তানকে বক্ষে ধারণ করেছে।
অরফালেজবাসী, তোমাদের সকলকে বিদায়।
এই দিন শেষ হয়েছে।
আমাদের সামনেই শেষ হয়েছে যেভাবে পদ্মফুল তার নিজের আগামীকালের উপর বন্ধ হয়ে যায়।
এখানে আমাদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তা তোমরা রেখে দেব, এবং যদি এটা পর্যাপ্ত না হয়, তারপর পুনরায় আমরা একত্রিত হব এবং আমরা সবাই একসংগে দাতার কাছে হাত তুলে চাইব।
কখনো ভুলে যেও না যে আমি আবার তোমাদের কাছে ফিরে আসব।
স্বল্পক্ষণ, এবং তারপর আমার আকাঙ্খা ধুলা এবং ফেনা জড়ো করবে অন্য একটা দেহের জন্য।
স্বল্পক্ষণ, বাতাসের উপর এক মুহূর্ত বিশ্রামের পর, এবং অন্য একজন স্ত্রীলোক আমাকে বহন করে আনবে।
তোমাদেরকে এবং যে যৌবন আমি তোমাদের সংগে কাটিয়েছি তাকে বিদায়।
এটা ছিল যেন গতকালের একটা স্বপ্নের ভিতর আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল।

আমার একাকীত্বের সময় তোমরা আমাকে গান শুনিয়েছ, আমি তোমাদের আকুল কামনা দিয়ে আকাশে সুউচ্চ মিনার তৈরী করেছি কিন্তু এখন আমাদের ঘুম পালিয়ে গেছে এবং আমাদের স্বপ্নও পালিয়ে গেছে, এবং এখন আর ভোরও নেই।

এখন আমাদের উপর মধ্যাহ্ন নেমেছে এবং আমাদের আধা-জাগ্রত অবস্থায়ই পরিপূর্ণ দিনে পরিণত হয়েছে, এবং আমরা অবশ্যই বিচ্ছিন্ন হব। যদি স্মৃতির গোধূলিতে আমরা আবার মিলিত হই, আমরা আবার একসংগে কথা বলব এবং তোমরা আমাকে আরও গভীর গান গেয়ে শোনাবে।

যদি আমাদের হাত অন্য একটা স্বপ্নের ভিতর মিলিত হয় তাহলে আমরা আকাশে অন্য একটা মিনার তৈরী করব।

এ কথা বলে তিনি নাবিকদের সংকেত দিলেন, এবং তারা নোঙর তুলে ফেলল এবং জাহাজকে শিকল থেকে উন্মুক্ত করে পূর্বদিকে যাত্রা করল।

জনতার ভিতর থেকে একটা সমবেত কান্নার রোল ভেসে এল যেন একই হৃদয় থেকে নিঃসৃত, এবং সেই কান্না উঠে চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিল এবং সমুদ্রের উপর দিয়ে বিশাল শীঙা বাজানোর মত চারিদিকে ছড়িয়ে গেল।

একমাত্র আলমিট্রাই ছিলেন নিঃশ্চুপ, তিনি কুয়াশার ভিতর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জাহাজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।

যখন সমস্ত মানুষ বাড়ী ফিরে গেল তখনও তিনি সমুদ্র প্রাচীরের উপরে একাকী স্হিরভাবে দাঁড়িয়ে তাঁর বলে যাওয়া কথাগুলো হৃদয়ের ভিতর স্মরণ করছিলেন:

“স্বল্পক্ষণ বাতাসের উপর একমুহূর্ত বিশ্রামের পর, এবং অন্য একজন স্ত্রীলোক আমাকে বহন করে আনবে”॥

সমাপ্ত

 

দ্যা প্রফেট (প্রথম অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (তৃতীয় অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (চতুর্থ অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (পঞ্চম অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (ষষ্ঠ অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (সপ্তম অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (অষ্টম অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (নবম অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (দশম অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (এগার অনুচ্ছেদ)

 

রোজীনা পারভীন বনানী 
ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top