দ্যা প্রফেট (দশম অনুচ্ছেদ) : কাহলীল জীবরান


প্রকাশিত:
২৭ জানুয়ারী ২০২১ ১৯:১৩

আপডেট:
২৭ জানুয়ারী ২০২১ ১৯:৩৫

ছবিঃ কাহলীল জীবরান এবং অনুবাদক রোজীনা পারভীন বনানী

 

মূল: কাহলীল জীবরান
অনুবাদ: রোজীনা পারভীন বনানী

 

দ্বাবিংশতি


তারপর একজন ধর্মজাজিকা বললেন, আমাদের প্রার্থনা সম্বন্ধে বলুন।
তিনি উত্তর দিলেন:

তুমি তোমার দুঃখ এবং প্রয়োজনের সময় প্রার্থনা কর; ভালো হতো যদি তুমি প্রার্থনা করতে তোমার পরিপূর্ণ আনন্দের সময় এবং তোমার প্রাচুর্যতাপূর্ণ দিনে। জীবন্ত মেঘমুক্ত নির্মল আকাশে তোমার বিস্তৃতিই কি প্রার্থনা নয়?

এবং প্রার্থনা যদি হয় তোমার স্বস্তির জন্য যে স্বস্তি তোমার অন্ধকারকে মহাশূন্যে বিন্দু বিন্দু ঢেলে দিয়ে পেয়েছ, তাহলে প্রার্থনা তোমার আনন্দের জন্যও যে আনন্দ তোমার হৃদয়ের ভোরে ফোঁটায় ফোঁটায় জমা হয়েছে। তোমার আত্মা তোমাকে প্রার্থনার জন্য বার্তা পাঠায় যদি তুমি তা না পার এবং কান্নাকাটি কর, সে তোমাকে পুনরায় উদ্দীপিত করবে এবং তারপর আবারো, কান্না থেকে যতক্ষণ না তুমি হাসিতে পৌঁছবে ততক্ষণ পর্যন্ত।

যখন তুমি প্রার্থনা করবে তখন তাদের সাক্ষাতের জন্য উপরে উঠবে যারা বাতাসের ভিতর ঠিক সেই সময়ে প্রার্থনা করছে, এবং প্রার্থনা ব্যতীত তাদের সাক্ষাৎ তুমি পাবে না। সুতরাং তুমি যখন সেই অদৃশ্য মন্দির পরির্দশন করবে তখন পরম উল্লাস এবং সুমধুর যোগাযোগ ছাড়া অন্য কিছুর জন্য যেন না হয়। যদি তুমি কোন উদ্দেশ্য ছাড়া শুধু অনুসন্ধান করার জন্য সেই মন্দিরে প্রবেশ কর তাহলে তুমি কিছুই পাবে না। যদি তুমি নিজেকে বিনয়ী করে তোলার জন্য এর ভিতর প্রবেশ কর তাহলে তোমাকে উত্তোলন করা হবে অথবা সমভাবে তুমি যদি অন্যদের জন্য ভাল কিছু ভিক্ষা করার জন্য প্রবেশ কর তাহলেও তোমার কথা শোনা হবে।

এইই যথেষ্ট যে তুমি মন্দিরে অদৃশ্যভাবে প্রবেশ করেছ।

আমি তোমাদেরকে কীভাবে শব্দ করে প্রার্থনা করতে হয় সেই শিক্ষা দিতে পারব না। যখন ইশ্বর তাঁর নিজের কথা তোমার ঠোঁটের মাধ্যমে উচ্চারণ করেন তখন ব্যতীত ঈশ্বর তোমার শব্দ শুনতে পান না এবং আমি তোমাদেরকে সাগরের এবং অরন্যের এবং পাহাড়ের প্রার্থনা সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে পারব না। কিন্তু তোমরা যারা পাহাড়ে, অরণ্যে এবং সাগরে জন্মগ্রহণ করেছ তারা তোমাদের প্রার্থনাকে হৃদয়ের ভিতর অন্বেষণ কর, এবং যদি তুমি রাত্রির স্হিরতায় শুনতে পাও তাহলে তুমি তাদের নৈঃশব্দের ভিতরও শুনতে পাবে:

আমাদের ঈশ্বর, তুমি আমাদের উড়ন্ত সত্তা, তোমার ইচ্ছার ভিতর দিয়েই আমাদের ইচ্ছা প্রকাশ পায়।
এটা তোমার আকাঙ্ক্ষা যা আমাদের ভিতরে আকাঙ্ক্ষা লাভ করে।
“আমাদের ভিতর এটা তোমারই অনুপ্রেরণা যা আমাদের রাত্রিকে পরিবর্তন করতে, যে রাত্রি তোমার, এবং পরিবর্তন করে দিনে, যে দিনও তোমার”।
“আমরা কোন কিছুর জন্য তোমার কাছে চাইব না, কারণ কোন কিছুর প্রয়োজন আমাদের মধ্যে জন্মানোর পূর্বেই তুমি তা জানতে পার”।
“তুমি আমাদের প্রয়োজন; আমাদেরকে তোমার নিজেকে দিয়েই তুমি তোমার সমস্ত দিয়েছ”।

 

ত্রয়োবিংশতি
তারপর একজন সন্ন্যাসী, যিনি বছরে একবার এই নগর পরিভ্রমণ করেন, সম্মুখে আসলেন এবং বললেন, আমাদের আনন্দ সম্বন্ধে বলুন।
এবং তিনি উত্তরে বললেন: আনন্দ একটা মুক্তির গান, কিন্তু এটাই মুক্তি নয়। আনন্দ তোমার আকুল আকাঙ্ক্ষাগুলোর প্রস্ফুটিত রূপ, কিন্তু এটাই তাদের ফল নয়। আনন্দ উচ্চতার প্রতি গভীরতার আহ্বান, কিন্তু এটা না গভীর না উচ্চ। এটা খাঁচায় বন্দী পাখির পাখা মেলে দেয়া, কিন্তু পরিবেষ্টিত মহাশূন্য নয়।
হ্যাঁ, প্রকৃত সত্য এই যে, আনন্দ একটা মুক্তির গান এবং আমি আনন্দিত হব যদি তুমি হৃদয়ের পরিপূর্ণতা নিয়ে এই গান গাও; তথাপি আমি আশা করছি এই গান গেয়ে তুমি তোমার হৃদয়কে হারাবে না।
তোমাদের যুবকদের ভিতর অনেকেই আনন্দ খোঁজে যেন এটাই সব, এবং তারা কঠোরভাবে সমালোচিত হয় এবং বিচারের সম্মুখীন হয়। আমি তোমাদের বিচার বা ভৎর্সনা কিছুই করব না। আমি তাদের আনন্দকে খুঁজতে বলব।
তারা আনন্দকে দেখতে পাবে, কিন্তু একাকী নয়; তার আরও সাত বোন আছে, এবং সবার ভিতর যে ছোট সে আনন্দের থেকেও বেশি সুন্দর। তোমরা কী সেই মানুষটার কথা শোননি, যে মাটি খুঁড়েছিল শিকড় দেখার জন্য এবং এক বিরাট রত্নভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছিল? এবং তোমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের ভিতর অনেকেই দুঃখানুভবসহ আনন্দকে স্মরণ করে মাতাল অবস্থায় ভুল সংঘটিত করার মত। কিন্তু দুঃখানুভব মনের একটা মেঘাচ্ছন্ন অবস্থা এবং এর শাস্তি নয়। তাদের উচিত আনন্দকে কৃতজ্ঞতার সংগে স্মরণ করা, যেমন তারা গ্রীষ্মের ফসলকে স্মরণ রাখে। তথাপি যদি তারা দুঃখানুভবে স্বাচ্ছন্দ্য পায়, তাদেরকে সেই স্বাচ্ছন্দ্য পেতে দাও।
তোমাদের ভিতর তারাও আছে যারা অনুসন্ধান করার মত যুবক নয় অযথা স্মরণ করার মত বৃদ্ধও নয়;
তারা অনুসন্ধান অথবা স্মরণ করার ভয়ে সমস্ত আনন্দকেই বর্জন করে, পাছে তারা আত্মাকে অবহেলা করে বা পীড়া দেয়।
কিন্তু এমনকি তাদের এই এড়িয়ে চলাটাও এক প্রকার আনন্দ এবং এইভাবে তারাও রত্নভাণ্ডারের দর্শন পায় যদিও শিকড়ের জন্য তারা কম্পিত হাতে মাটি খনন করে।
কিন্তু আমাকে বল, কে সে যে আত্মাকে অসন্তুষ্ট করতে পারে? নাইটিংগেল কি রাত্রির নিস্তব্ধতাকে বিরক্ত করে, অথবা জ্বোনাকী পোকা কি নক্ষত্রকে?
তোমাদের প্রজ্জ্বলিত আগুনের শিখা অথবা ধোঁয়া কি বাতাসকে বাঁধা দেয়?
তুমি কি আত্মাকে একটা শান্ত পুকুর রূপে চিন্তা কর যাকে ছড়ির আঘাতে উত্তাল করে তোলা যায়?
মাঝে মাঝে নিজেকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে তুমি তোমার সত্তার গহ্বরে কামনা সঞ্চয় কর। কে বলতে পারে যে আজকে যা অস্বীকার করা হয়েছে, তাই আগামীকাল অপেক্ষা করে নেই?
তোমার দেহ জানে তার আবাসস্হল এবং সঠিক প্রয়োজন এবং নিজেকে প্রতারিত করে না।
এবং তোমার দেহই তোমার মনের বীণা, এবং এর সুমধুর সঙ্গীত ও বিভ্রান্ত স্বর উভয়ই তোমার।
এখন তুমি তোমার হৃদয়ের ভিতর জিজ্ঞাসা কর, “আমরা কিভাবে আলাদা করব আনন্দের ভিতর কোনটা ভাল কোনটা ভাল নয় ?”
ঈশ্বর তোমাদের ফসলের মাঠ এবং ফুলের বাগান দিয়েছেন, এবং সেখান থেকে তোমরা শিক্ষা নেবে যে ফুল থেকে মধু আহরণ করার ভিতরই ভ্রমরের সমস্ত আনন্দ, কিন্তু ভ্রমরকে সমস্ত মধু দিয়ে দেওয়াটাই ফুলের আনন্দ। একটা ভ্রমরের কাছে একটা ফুলই জীবনের ঝরনার মত, এবং ফুলের কাছে একটা ভ্রমরই ভালবাসার দূত, এবং উভয়ের কাছে, ভ্রমর এবং ফুল, এই আনন্দের দেয়া এবং নেয়াটাই একটা প্রয়োজন এবং পরম উল্লাস।
অরফালেজবাসী, তোমাদের আনন্দের ভিতর ফুল এবং ভ্রমরকে অনুসরণ কর।।

 

চতুর্বিংশতি

একজন কবি বললেন, আমাদের সৌন্দর্য সম্বন্ধে বলুন।
তিনি উত্তর দিলেন:
তুমি কোথায় সৌন্দর্যকে খুঁজবে, এবং কিভাবে তাকে পাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজে তোমার পথে না আসে এবং তোমাকে পথ প্রদর্শন না করে? তুমি কিভাবে তার সম্পর্কে কথা বলবে যদি না সে তোমার কথার বয়নকারী হয়?
যে আহত এবং দুঃখিত হয়েছে সে বলবে, “সৌন্দর্য বিনয়ী এবং ভদ্র”।
“সৌন্দর্য একটা যুবতী মাতার মত যে তার অর্ধ-লজ্জিত উজ্জ্বলতা নিয়ে আমাদের মাঝে হাঁটছে”।
এবং আবেগাপ্লুত একজন বলবে, “না, সৌন্দর্য একটা প্রচণ্ড ক্ষমতা এবং ভয়ানক আতঙ্কের বিষয়”।
“প্রচণ্ড ঝড়ের মত সে আমাদের নীচে  পৃথিবীকে ঝাকুনি দিচ্ছে এবং আমাদের উপরের আকাশকে”।
যারা ক্লান্ত এবং শ্রান্ত তারা বলে, “সৌন্দর্য একটা মৃদু শিস্-এর মত। সে আমাদের আত্মার ভিতর কথা বলে”।
“তার স্বর আমাদের নৈঃশব্দ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে একটা মৃদু আলোর মত যা ছায়ার ভয়ে কম্পিত”।
যারা বিরামহীন তারা বলে, “আমরা পাহাড়ের ভিতর তার চিৎকার শুনেছি, এবং তার চিৎকারের সংগে হিংস্র জন্তুর পায়ের ক্ষুরের শব্দ, পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ এবং সিংহের গর্জনের শব্দ আসে”।
রাতে নগরীর নৈশ প্রহরীরা বলে, “পূব আকাশে ভোরের সংগে সৌন্দর্য উঠে”।
এবং দিনের বেলায় শ্রমিকরা এবং পথিকরা বলে, “আমরা তাকে সূর্যাস্তের জানালা দিয়ে পৃথিবীর উপর আনত অবস্হায় দেখেছি।”
শীতকালে যে প্রচন্ড তুষারপাতে আটকে পড়েছে সে বলে, “সৌন্দর্য পাহাড়কে ডিঙিয়ে বসন্তের সংগে আসবে।”
এবং গ্রীষ্মের তপ্ত গরমে যে কৃষক ফসল কাটে সে বলে, “আমরা তাকে শরৎকালের পাতার সাথে নাচতে দেখেছি, এবং আমরা তার চুলে তুষারস্তুপ দেখেছি।”
সৌন্দর্য সম্পর্কে তুমি এইসবই বলতে পারো, তথাপি প্রকৃত সত্য এই যে তুমি তার সম্পর্কে কিছু বলনি বরং তোমার অপরিতৃপ্ত প্রয়োজন সম্পর্কে বলেছ এবং সৌন্দর্য কোন প্রয়োজন নয় বরং একটা উল্লাস।
সৌন্দর্য কোন তৃষ্ণার্ত মুখ নয় বা সন্মুখে বিস্তৃত কোন শূন্য হাতও নয়, বরং একটা প্রজ্জ্বলিত হৃদয় এবং একটা বিমোহিত আত্মা। সৌন্দর্য কোন প্রতিবিম্ব নয় যা তুমি দেখতে পার অথবা কোন গান নয় যে তুমি শুনতে পার,
বরং সেই প্রচ্ছায়া যা তুমি চোখ বন্ধ করেও দেখতে পাবে এবং সেই গান যা কান বন্ধ করেও শুনতে পাবে।
সৌন্দর্য গাছের বাকলের খাঁজে সঞ্চিত কোন রস নয়, অথবা হিংস্র পাখির কোন নখরও নয়, বরং চিরপ্রস্ফুটিত একটা ফুলের বাগান এবং চিরউড়ন্ত এক ঝাঁক স্বর্গীয় অপ্সরী, অরফালেজবাসী, সৌন্দর্যই জীবন যখন জীবন ঘোমটা খুলে তার পবিত্র মুখ বের করে রাখে কিন্তু তোমারই জীবন এবং তোমারই ঘোমটা।
সৌন্দর্য একটা অনন্তসত্য যা একটা আয়নার ভিতর দিয়ে নিজের দিকে স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিন্তু তোমরাই অনন্তসত্য এবং তোমরাই সেই আয়না।।

চলবে

 

দ্যা প্রফেট (প্রথম অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (তৃতীয় অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (চতুর্থ অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (পঞ্চম অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (ষষ্ঠ অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (সপ্তম অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (অষ্টম অনুচ্ছেদ)
দ্যা প্রফেট (নবম অনুচ্ছেদ)

 

রোজীনা পারভীন বনানী 
ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top